Total Pageviews

Friday, December 30, 2011

ধনেপাতায় ধনদৌলত

নিজের ধনেপাতা খেতে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ভেতরকুঠি গ্রামের তৈয়ব আলী
ছবি: প্রথম আলো
শীত মৌসুমে ধনেপাতার কদর বাঙালির ঘরে ঘরে। তরিতরকারিতে স্বাদ আনতে ধনেপাতার জুড়ি নেই। মচমচে মুড়ি, তেল-মরিচ-পেঁয়াজের সঙ্গে ধনেপাতা কুচি কুচি করে কেটে মেখে খেতে খুবই মজা। অনেকেই আছেন, পাতে একটু ধনেপাতার ভর্তা হলেই তাঁদের ভরপেট ভাত খাওয়া হয়ে যায়।
গ্রামবাংলার অনেক বাড়িতে ধনেপাতার চাষ করে মূলত পরিবারের চাহিদা মেটানো হয়। তবে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সাড়াই ইউনিয়নের ভেতরকুটি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় ধনেপাতার। ১৬ বছর আগে তৈয়ব আলীর (৬০) হাত ধরে সূচনা হয় এ চাষের। তাঁর সাফল্য দেখে গ্রামের অন্যরাও চাষে লেগে পড়েন। এখন গ্রামের মাঠের পর মাঠ ধনেপাতার চাষ হয়। যাঁদের জমি নেই, তাঁরা বর্গা নিয়ে চাষ করেন।
অথচ একসময় এ গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিলেন অভাবী। উঁচু এলাকা বলে ধানসহ অন্যান্য ফসল এখানে ভালো হতো না। খাবারও জুটত না অনেকের। তবে এখন দিন বদলেছে। ভেতরকুটির মানুষ ধনেপাতা চাষ করে ভালো করেছেন আর্থিক অবস্থা। এই গ্রামের সবাই বেশ সচ্ছল, সুখী জীবন।
এক দিন সেই গ্রামে: কাউনিয়া উপজেলার সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে ভেতরকুটি গ্রাম। লোকসংখ্যা হাজার দেড়েক।
কাঁচা-পাকা পথ ধরে গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মাঠজুড়ে অসংখ্য ধনেপাতার খেত। বেশির ভাগ বাড়িতে চকচক করছে টিনের চাল। আধাপাকা বাড়িও আছে কয়েকটি। কোথাও শণ বা খড়ের কুঁড়েঘর দেখা গেল না। তৈয়ব আলীর বাড়ি খোঁজ করতেই একজন দেখিয়ে দেন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, তৈয়ব ধনেপাতা তুলছেন, সঙ্গে পুত্রবধূরাও।
সংগ্রাম: ১৯৫১ সালে অভাবের সংসারে জন্ম তৈয়ব আলীর। লেখাপড়া করা হয়নি। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি বড়। ১০ বছর বয়সে মারা যান বাবা। ১১ বছর বয়সে হারান মাকে। ১৩ বছর বয়সে ধরেন সংসারের হাল।
বাড়িতে ধান সিদ্ধ করে চাল তৈরির পর তা বাজারে বেচার কাজ শুরু করেন তৈয়ব। কয়েক বছর চালের ব্যবসা করেন, কিন্তু অভাব পিছু ছাড়ে না। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে চালের ব্যবসা ছেড়ে দেন। কয়েক মাস বেকার ঘুরে বেড়ানোর পর গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের পরামর্শে শুরু করেন কাঁচা তরকারির ব্যবসা। ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে খেত থেকে করলা কিনতে পাশের নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী গ্রামে যান। সেখানে নাজমুল নামের একজনের কাছে ধনেপাতা চাষ করে ভাগ্য বদলানোর গল্প শোনেন। বিষয়টি তাঁর মনে ধরে। ঠিক করেন, ধনেপাতা চাষ করে অভাব জয় করবেন।
ওই বছরের নভেম্বরে ১০ শতক জমিতে তিনি ধনেপাতার চাষ করেন। ৩০ দিনে এ ধনেপাতা বেচে খরচ বাদে চার হাজার টাকা আয়ও হয়। পরের বছর ৪০ শতকে দুই দফায় ৭০ দিনে চাষ করে আয় করেন ৩০ হাজার টাকা। এরপর পুরোপুরি লেগে পড়েন। স্ত্রী-পুত্ররাও তৈয়ব আলীর সঙ্গে হাত লাগান। সংসারে আসে সচ্ছলতা।
ধনেপাতার চাষের টাকায় কেনেন তিন একর জমি, বানান পাকা বাড়ি। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তিন ছেলে ধনেপাতা আর নানা সবজি চাষে লেগে আছেন। এবার দেড় একর জমিতে ধনেপাতার চাষ করে এক লাখ টাকা আয় করেছেন।
ভাগ্য বদলাল যাঁরা: ভেতরকুটি গ্রামের আবুল কালাম সংসার চালাতে কখনো দিনমজুরি, কখনো বা রিকশা চালাতেন। এর পরও আট সদস্যের পরিবারে অভাব লেগে থাকত। তৈয়ব আলীর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি অন্যের ১৫ শতক জমি বর্গা নেন।
শুরু করেন ধনেপাতার চাষ। বদলে যায় ভাগ্যের চাকা। ধনেপাতা বেচার টাকায় কেনেন দেড় একর জমি। বানান পাকা বাড়ি। এবার ৮০ শতকে ধনেপাতার চাষ করে আয় করেছেন ৫২ হাজার টাকা।
গ্রামের মোসলেমার স্বামী ২০ শতক বসতভিটা আর দুই সন্তান রেখে ১২ বছর আগে মারা যান। অসহায় মোসলেমা শুরু করেন দিনমজুরি। এ কষ্ট দেখে তৈয়ব আলী পরামর্শ দেন ধনেপাতা চাষের। তৈয়বের কাছ থেকে বীজ নিয়ে মোসলেমা বসতভিটার চারদিকে ধনেপাতা চাষ করেন।
৩০ দিনের মধ্যে এ ধনেপাতা বেচে আয় হয় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। পরের বছর অন্যের ২০ শতক জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। এবার ৭০ শতক জমিতে এ ফসলের চাষ করেছেন। সন্তানদের নিয়ে বেশ ভালো আছেন।
গ্রামের আবদুল হালিম, ফিরোজা বেগম, মঞ্জিলা খাতুন, মোর্শেদা বেগম, সাহেদা খাতুন, জহরা বেগম, লাল মিয়াসহ অনেকেই ধনেপাতা চাষ করে ভাগ্য বদলের গল্প শোনালেন।
লাভ অনেক: গ্রামের কৃষক মোবারক হোসেন বলেন, ধনেপাতা চাষে পরিশ্রম কম। চারবার লাঙলের হাল দিয়ে চাষ করে একরে ৭০ কেজি ধনেপাতার বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। বীজ বপনের ২০ দিনের মাথায় হালকা একটা সেচ দিতে হয়। সার, কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। লাগে না তেমন পরিচর্যাও। ৩০ দিন পর খেত থেকে ধনেপাতা তুলে ওই জমিতে আবারও ধনেপাতা চাষ করা যায়।
কাউনিয়া উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুভলচন্দ্র বর্মণ বলেন, ধনেপাতার চাষ খুবই লাভজনক। এক একর জমিতে ধনেপাতা চাষ করতে বীজ-গোবর-চাষাবাদ বাবদ নয় থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। শুরুতে ১০০ টাকা এবং শেষে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও একরপ্রতি ৬০ হাজার টাকা আয় হয়, যা অন্য কোনো ফসল থেকে এত কম সময়ে আয় করা যায় না।
ধূমেরকুটি গ্রামের ধনেপাতার পাইকারি ব্যবসায়ী লাল মিয়া ও আবু বকর জানান, তাঁরা খেত থেকে ধনেপাতা কেনেন। এরপর হকের বাজার, মায়ার বাজার, খানসামা বাজার, কাউনিয়া বাজার, মেরাজের বাজারে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।
অন্যদের কথা: সাড়াই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, এক যুগ আগেও ভেতরকুটি গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। উঁচু এ এলাকায় ফসলাদি ভালো হতো না। এখন ধনেপাতাসহ নানান সবজি চাষ করে গ্রামবাসী অভাবকে জয় করেছেন। এ গ্রামের মানুষের সাফল্য দেখে পাশের বাইরাকুটি, সোনাতলা, কদমতলা, বালাপাড়া, বিশ্বনাথ চরে কৃষকেরা এসব ফসলের চাষ করছেন।
কাউনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, ভেতরকুটি গ্রামে ১৪-১৫ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে ধনেপাতার চাষ হচ্ছে। গ্রামের অন্তত ৭০ শতাংশ লোক এ চাষের সঙ্গে জড়িত। পুরো উপজেলায় প্রায় ৭২০ একর জমিতে ধনেপাতার চাষ হয়। prothom-alo

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons