Total Pageviews

Friday, September 16, 2011

দীপ জ্বেলে যাই

পঞ্চগড় পৌরসভার তুলারডাঙ্গা গ্রামে জনির পাঠশালায় পাঠদান চলছে পঞ্চগড় পৌরসভার তুলারডাঙ্গা গ্রামে জনির পাঠশালায় পাঠদান চলছে
ছবি: প্রথম আলো
ছেলে অসুস্থ। ওষুধ খাওয়াতে হবে। আশপাশে কেউ নেই যে সাহায্য নেবেন। গ্রামের নিরক্ষর মা ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন। একপর্যায়ে ওষুধ মনে করে ঘরে থাকা কীটনাশক ছেলের মুখে তুলে দিলেন। যখন বুঝতে পারলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছেলে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
মর্মান্তিক এ ঘটনা প্রতিবেশী এক তরুণের মনে নাড়া দেয়। ওই তরুণ ভাবেন, ওই মা যদি লিখতে-পড়তে পারতেন, তবে হয়তো এমন ভুল করতেন না। এসব মানুষকে শিক্ষার আলো দেওয়ার ব্রত নেন তিনি। সেই ব্রত থেকেই গ্রামে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। গৃহশিক্ষকতা করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে যাত্রা শুরু সেই পাঠশালার, যেটি পরিচিতি পায় ‘জনির স্কুল’ নামে।
তরুণের নাম নজরুল ইসলাম জনি। পঞ্চগড় পৌরসভার তুলারডাঙ্গা গ্রামে তাঁর বাড়ি। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। এরপর ওই স্কুল নিয়েই ব্যস্ত।
শুরুর কথা: মন নাড়া দেওয়া ওই ঘটনাটি ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের। এ ছাড়া লেখাপড়া না জানায় গ্রামের সাধারণ মানুষের নানাভাবে প্রতারণার শিকার হওয়া, শিশু ও নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, মাদকের ছোবল তো আছেই। বিষয়টি ভাবায় জনিকে। তিনি চিন্তা করেন, শিক্ষাই এর সমাধান। এসব নিয়ে আলোচনা করেন সহপাঠী একই গ্রামের একরামুল হাসানের সঙ্গে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন পাঠশালা গড়বেন। দুই বন্ধু মিলে ঠিক করেন জনির বাড়ির পাশের সুপারির বাগানে গ্রামের নিরক্ষরদের পড়ানো হবে।
জনি ও একরামুল তাঁদের ইচ্ছার কথা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানান। নিরক্ষর নারী-পুরুষকে পড়তে আসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু নারীদের ঘর থেকে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁরা হাল ছাড়েননি। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে খোলা আকাশের নিচে শুরু হয় লেখাপড়া। প্রথমদিকে সেখানে পড়তে আসত মাত্র ১৮ থেকে ২০ জন। দুটি পালায় পড়ানো শুরু হয়। বিকেলে পড়েন নারীরা, রাতে পুুরুষেরা। জনির প্রাইভেট পড়ানোর টাকায় কেনা তিনটি হারিকেন ও পাঁচ লিটার কেরোসিন তেল দিয়ে শুরু হয় রাতের পড়া।
দিনের পালায় পড়ানো ভালোমতো চললেও রাতের পালায় সমস্যা হতো। কারণ, কেরোসিন কেনার খরচ কম নয়। একপর্যায়ে একরামুলের সহায়তা আর পান না জনি।
জনির হার না মানা মানসিকতা দেখে এগিয়ে আসেন গ্রামের দিনার চৌধুরী। দুজনে মিলে স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের বই, খাতা-কলম, চক-ডাস্টার, বসার চট, মোমবাতি-হারিকেনসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করেন। তার পরও যেন এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছিল না। জনির উদ্যোগের কথা জানতে পেরে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা এগিয়ে আসেন।
জনির বাড়ির উঠানে টিনের চালা করে বানানো হয় পাঠশালা। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বর্তমানে তিন পালায় চলছে পাঠদান। দুপুরের পালায় পড়ানো হয় শিশুদের। বর্তমানে এ পালায় সুবিধাবঞ্চিত ৩৬টি শিশু পড়াশোনা করছে। বিকেলের পালায় পড়ছেন ৩০ জন নারী। আর রাতের পালায় পড়েন ২৫ থেকে ৩০ জন পুরুষ। কাউকে বেতন দিতে হয় না।
পাঠশালার শিক্ষক বলতে জনি নিজেই। শিশুরা ছয় মাস এখানে পড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়। বয়সী নারী-পুরুষেরাও ছয় মাস এখানে পড়েন।
আরও কিছু: জনির পাঠশালায় লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রথা রোধ, ঝগড়া-বিবাদ নিষ্পত্তি, মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। বিপদে-আপদে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করা, সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলা, বাড়িতে ছোটখাটো খামার তৈরি, শাকসবজির বাগান, হাঁস-মুরগি-কবুতর, গরু-ছাগল পালনেও উদ্বুদ্ধ করা হয়।
একদিন পাঠশালায়: জনির পাঠশালায় ঢুকে দেখা গেল, দুই সারিতে বসে শিশুশিক্ষার্থীরা বই নিয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার জানাল, সে আগে স্কুলে যেতে পারেনি। এখন জনির স্কুলে এসে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক সব বিষয় পড়ছে।
কথা হলো বিকেলের পালায় পড়তে আসা গৃহবধূ আছিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বললেন, পড়তে না পারায় ওষুধ ভেবে ছেলেকে কীটনাশক খাইয়েছিলেন। সেই যন্ত্রণা এখনো ভোগ করছেন। এ স্কুলে এসে এখন পড়া ও লেখা দুটোই পারেন। ‘ছোটবেলায় পড়ালেখা করতে পারিনি। কম বয়সেই বিয়ে হয়। পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল। এখন এই স্কুলে এসে পড়াশোনা করছি।’ বলছিলেন গৃহবধূ মমতাজ বেগম। গৃহবধূ সহিদা বেগম বললেন, প্রথম প্রথম পড়তে আসতে লজ্জা লাগত। কিন্তু এখন ভালোই লাগছে।
সারা দিন খাটা-খাটুনির পর রাতের পালায় পড়তে আসেন মনজুর রহমান (৪০)। ‘পড়াশোনা না জানলে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এখন পড়তে ও লিখতে পারি।’ সরল উত্তর মনজুরের।
অন্যদের কথা: জনির সহযোগী দিনার বলেন, ‘জনির মহ ৎ উদ্যোগ আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই ওঁর সঙ্গে যোগ দিই। এই উদ্যোগে সহযোগিতা করতে পেরে ভালোই লাগছে।’
জনির বাবা আবদুস ছাত্তার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আবদুস ছাত্তার বলেন, এ কাজকে প্রথমদিকে ছেলের পাগলামি মনে হতো। এখন সবাই ছেলের প্রশংসা করে। খুব গর্ব হয়।
পঞ্চগড়-১ আসনের সাংসদ মো. মজাহারুল হক প্রধান এ উদ্যোগের প্রশংসা করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এমন উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। একই কথা বলেন পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র তৌহিদুল ইসলাম। তিনি স্কুলের উন্নয়নে সহযোগিতাও করেছেন।
জনির ইচ্ছা: এরই মধ্যে কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন জনি। সাক্ষরতাদানে বিশেষ অবদান রাখায় ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে জেলা প্রশাসন জনিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সম্মাননা সনদ’ দিয়েছে।
জনি বলেন, ‘ইচ্ছা আছে পাঠশালার জন্য একটি পাকা ঘর তৈরি করার। সেখানে বিদ্যু ৎ, পানীয় জল এবং শৌচাগার থাকবে। এ ছাড়া সুযোগ পেলে এ এলাকার প্রতিটি গ্রামে এমন একটি করে পাঠশালা গড়ে তুলব।

Wednesday, September 14, 2011

 কিলিমানজারো জয় করলেন মুসা ইব্রাহীম ও নিয়াজ

কিলিমানজারোর উহুরু পিক-এ বাংলাদেশের পতাকা হাতে (বাঁ থেকে) নিয়াজ মোরশেদ পাটওয়ারী ও মুসা ইব্রাহীম: কিলিমানজারোর উহুরু পিক-এ বাংলাদেশের পতাকা হাতে (বাঁ থেকে) নিয়াজ মোরশেদ পাটওয়ারী ও মুসা ইব্রাহীম: ছবিটি ই-মেইলে পাঠিয়েছেন মুসা ইব্রাহীম
বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীম এবার জয় করলেন আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট কিলিমানজারো। নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশের (এনএসিবি) এই অভিযানে মুসার সঙ্গে এ পর্বতচূড়া জয় করেছেন নিয়াজ মোরশেদ পাটওয়ারী। কিলিমানজারো জয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের (সেভেন সামিট) দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করল এনএসিবি।
মুসা ইব্রাহীম ই-মেইল বার্তায় জানান, ১২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় সকাল সাতটা ৪৮ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ১০টা ৪৮ মিনিট) কিলিমানজারো জয় করেন দুই বাংলাদেশি পর্বতারোহী। তানজানিয়ায় অবস্থিত ১৯ হাজার ৩৪০ ফুট উঁচু আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতে এদিন এনএসিবির সাধারণ সম্পাদক মুসা ইব্রাহীম ও সদস্য এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক নিয়াজ মোরশেদ পাটওয়ারী বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। এনএসিবির পক্ষ থেকে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।
জানা যায়, এই অভিযানে কিলিমানজারো পর্বতের মাচামি রুট অনুসরণ করা হয়। তবে এই অভিযানের অপর সদস্য ৫৭ বছর বয়সী এম এ সাত্তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১১ সেপ্টেম্বর ১৩ হাজার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট বারানকো ক্যাম্প থেকে মোশি শহরে ফিরে আসেন।
এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর এনএসিবির সদস্যরা ছয় হাজার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মাচামি গেট থেকে কিলিমানজারো পর্বতাভিযান শুরু করেছিলেন। এরপর মাচামি ক্যাম্প, শিরা ক্যাম্প ও বারানকো ক্যাম্প হয়ে তাঁরা ১১ সেপ্টেম্বর ১৫ হাজার ৮৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট সর্বশেষ ক্যাম্প বারাফুতে পৌঁছান। এখান থেকে অভিযাত্রীরা ১২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় রাত সোয়া একটায় পর্বতচূড়া জয়ের জন্য যাত্রা (সামিট পুশ) শুরু করেন। ছয় ঘণ্টা ৩৩ মিনিট আরোহণ শেষে তাঁরা কিলিমানজারোর সর্বোচ্চ পয়েন্ট ১৯ হাজার ৩৪০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট উহুরু পিকে পৌঁছে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। একই দিন তাঁরা ১০ হাজার ১৬৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মেওকা ক্যাম্পে নেমে আসেন।
এনএসিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, গতকাল মেওকা গেটে কিলিমানজারো ন্যাশনাল পার্ক ও তানজানিয়া ন্যাশনাল পার্ক কর্তৃপক্ষ তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে উহুরু পিক আরোহণ করার সনদ দেন। ২০ সেপ্টেম্বর তাঁরা দেশে ফিরবেন।
সামিট গ্রুপ, এমিরেটস এয়ারলাইনস, শাহ্ সিমেন্ট, জেএএন অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড ও ডেইলি স্টার এনএসিবির সেভেন সামিট অভিযানের কিলিমানজারো পর্বতাভিযান পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
কিলিমানজারো অভিযানের প্রাক্কালে মুসা ইব্রাহীমকে বাংলাদেশের পর্যটন দূত হিসেবে ঘোষণা দেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের। মুসা ইব্রাহীম ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করে সেভেন সামিটের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করেন।

Friday, September 2, 2011

মাহামুদা এখন সবার প্রিয়

হাতপাখা তৈরি করতে ব্যস্ত তারাগঞ্জ উপজেলার পাশারী পাড়া গ্রামের মাহমুদাসহ গ্রামের অন্য নারীরা হাতপাখা তৈরি করতে ব্যস্ত তারাগঞ্জ উপজেলার পাশারী পাড়া গ্রামের মাহমুদাসহ গ্রামের অন্য নারীরা
ছবি: প্রথম আলো
চতুর্থ শ্রেণীতে উঠে অভাবের কারণে স্কুল ছেড়েছিল মেয়েটি। ১৪ বছর বয়সে বাধ্য হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে বসতে। দিনমজুর স্বামীর সংসারে এসেও অভাব পিছু ছাড়েনি। জোটেনি ঠিকমতো দুইবেলা ভাতও। এরই মধ্যে মেয়েটি স্বপ্ন দেখেছে নিজে কিছু করার। একসময় শুরু করে হাতপাখা তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা। আসে সাফল্য। অভাবের সংসারে আসে সচ্ছলতা।
এই সংগ্রামী মানুষটির নাম মাহামুদা বেগম। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের পাশারীপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি।
হাতপাখা তৈরি করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাঁর দেখানো পথেই ওই গ্রামের অন্তত তিন শতাধিক গৃহবধূ দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। তালপাখা তৈরি করে বেশ কাটছে তাঁদের দিন।
মাহামুদা এখন গ্রামের সবার প্রিয়। তাঁর স্বামীর কথা, ‘অর জন্যে হামারা এলা সমাজোত মাথা উঁচা করি চলবার পারি।’
সংগ্রাম: তারাগঞ্জের হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের নদীরপার গ্রামে ১৯৬৫ সালে দরিদ্র পরিবারে জন্ম মাহামুদার। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবার অভাবের সংসার। ১৯৭৯ সালে বাবা মোবারক হোসেন কিশোরী মেয়েকে তুলে দেন পাশারীপাড়া গ্রামের খোয়াজ উদ্দিনের হাতে।
স্বামীর বাড়িতে এসেও সুখ হয়নি মাহামুদার। প্রায়ই অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হতো। কিন্তু এত অভাব, এত দরিদ্র তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাঁর কিশোরী মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। মুড়ি বানিয়ে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। এতে কিছু আয় হয়। এক বছরের লাভের টাকায় কেনেন চারটি ছাগল। তাঁর নতুন জীবনের গল্পটা এখান থেকে শুরু।
গল্পটা এ রকম: ১৯৯০ সালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা গ্রামের হাতপাখা বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম পাশারীপাড়া গ্রামে পাখা নিয়ে আসেন। মাহামুদা তাঁর কাছ থেকে দুটি পাখা কেনেন। হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি এলে তিনি মাহামুদার বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নেন। সারা দিনে ঝড়-বৃষ্টি না থামায় তাঁকে রাত যাপন করতে দেন মাহামুদার শ্বশুর আফজাল হোসেন। রাতে খাওয়ার সময় নানা কথার ফাঁকে রফিকুল মাহামুদাকে পাখা তৈরির পরামর্শ দেন। পরের দিন পাখা বিক্রি শেষে বিকেলে রফিকুল তাঁর বাড়িতে মাহামুদা ও তাঁর শ্বশুরকে নিয়ে যান। রফিকুলের স্ত্রী মমতাজ খাতুন মাহামুদাকে দুই দিনে শিখিয়ে দেন পাখা তৈরির কলাকৌশল।
বাড়ি ফিরে মাহামুদা তাঁর স্বামীকে তালপাতা সংগ্রহ করতে বললে তিনি এনে দেন। দুই দিনে মাহামুদা তৈরি করেন ২৫টি পাখা। এ পাখা বেঁচে আয় হয় ৮০ টাকা। খুলে যায় মাহামুদার চোখ। স্বামী-স্ত্রী লেগে পড়েন পাখা তৈরির কাজে। ভালো মুনাফা হওয়ায় বদলাতে থাকে সংসারের মলিন চেহারা।
তাঁর উন্নতি দেখে প্রতিবেশী অন্য নারীরা পাখা তৈরির কৌশল শিখতে আসেন। মাহামুদা তাঁদের শিখিয়ে দেন।
পাশারীপাড়া গ্রামের তিন শতাধিক গৃহবধূ ছাড়াও দামোদরপুর, ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের শতাধিক নারী এখন পাখা তৈরি করে বেশ আয় করছেন।
মাহামুদা পাখা বিক্রির টাকায় এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কিনেছেন আবাদি জমি। খড়ের ঘরের জায়গায় উঠেছে টিনের ঘর। বাড়িতে বসিয়েছেন নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। তিনটি গাভি, হাঁস-মুরগি ও ছাগল আছে। নলকূপের কিনারেই বানিয়েছেন ছোট্ট একটি পুকুর, তাতে চলছে হাঁস পালন ও মাছের চাষ। তাঁর দুই মেয়ে লেখাপড়া করছে। দুই ছেলে বিয়ের পর পাখার ব্যবসা করে আলাদাভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
মাহামুদার পথ ধরে: মাহামুদার পথ অনুসরণ করে যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের একজন লাইলী খাতুন। ১২ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। এখন প্রতি মাসে তাঁর গড়ে তিন হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
হাছিনা খাতুনের স্বামী মনোয়ার হোসেন জুয়া খেলতেন। হাছিনা সংসার চালাতেন ঝিয়ের কাজ করে। মাহামুদার পরামর্শে ১০ বছর আগে তিনি হাতপাখা তৈরি শুরু করেন। স্বামী জুয়া ছেড়ে এখন করেন পাখা বিক্রির ব্যবসা।
সোহাগী খাতুনের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। ভূমিহীন স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। তিন সন্তান নিয়ে প্রায়ই উপোস থাকতে হতো। এখন তাঁর পাখা তৈরির আয়ের টাকায় সংসার চলছে, স্বামীর আয় জমা থাকছে।
ওই পল্লিতে এক দিন: পাশারীপাড়া গ্রামের ৩০০টি পরিবারের কেউ পাখার কারিগর, কেউ ব্যবসায়ী। সম্প্রতি গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, কেউ পাখা বানাচ্ছে, কেউ তালপাতা পানিতে ভেজাচ্ছে। কেউ পাখার জন্য বাঁশের শলা কেটে রোদে শুকাতে দিচ্ছে। ঘরের কাজ সামলাতে সামলাতে, বিশ্রাম নিতে নিতে চলছে পাখা তৈরির কাজ।
মাহামুদার বাড়িতে দেখা গেল, তিনি পাখা বানাচ্ছেন। তাঁকে সহায়তা করছে দুই মেয়ে। গ্রামের অন্য ১৫-২০ জন নারীও তাঁর উঠানে বসে পাখা বানাচ্ছেন।
পাখার কারবার শুরু হয় চৈত্র মাস আসার আগেই। চলে কার্তিকের শুরু পর্যন্ত।
তৈরির কৌশল: ঘুরানি, পকেট, হরতন, মোড়া, একডান্ডা, ধাড়াইসহ বিভিন্ন ধরনের পাখা তৈরি করেন তাঁরা। পাখা তৈরিতে মূলত ব্যবহূত হয় তালপাতা, বাঁশ, খুদে পেরেক, সুই-সুতা ও রং। প্রথমে শুকানো তালপাতা চার-পাঁচ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তালপাতা পানি থেকে তুলে বাঁশের কঞ্চির কলম লাগিয়ে রোদে শুকাতে হয়। এরপর রাতে খোলা আকাশের নিচে রেখে সকালে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে তালপাতার চারদিকে গোলাকার করা হয়। সবশেষে পাখায় সুই-সুতার কাজ করা হয়। এরপর রং দিয়ে চোখ জুড়ানো নানা নকশা করা হয়।
পাখা তৈরির কারিগর আসমা খাতুন জানান, একটি তালপাতা তাঁরা নয়-১০ টাকায় গাছের মালিকদের কাছ থেকে কেনেন। একটি তালপাতা দিয়ে ১০ থেকে ১৪টি পর্যন্ত পাখা বানানো যায়। পাইকারেরা গ্রামে এসে পাখা কিনে নিয়ে যায়। এ পাখা চলে যায় দিনাজপুর, রাজশাহী, নীলফামারী, গাইবান্ধা। ঢাকায়ও যায়। প্রতিটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ে দুই থেকে তিন টাকা। বিক্রি হয় আট থেকে ১০ টাকা। একজন কারিগর দিনে ৩০-৩৫টি পাখা তৈরি করতে পারেন।
পরিবারের কথা: মাহামুদাকে নিয়ে গর্বিত তাঁর স্বামী খোয়াজ উদ্দিন। আলাপকালে বললেন, ‘বাহে, আগোত সমাজোত হামার কোনো দাম আছিল না। সোবায় মোক ডাকতো কিষান খাটা কয়া। অভাবের জন্যে মাহামুদার সাথে মোর প্রত্যেক দিন ঝগড়াও নাগছিলো। আশ্বিন-কার্তিক মাসতো থাকপার নাগছিলো সেক আলু উসা (মিষ্টি আলু সেদ্ধ) খায়া। মাহামুদাই সংসারের চাকা ঘুরি দিছে। অর জন্যে হামরা এলা সমাজোত মাথা উঁচা করি চলবার পারি।’
মাহামুদার ছেলে রবিউল ইসলামেরও একই কথা, ‘আগতো গ্রামের ছেলেমেয়েরা হামাক কিষান খাটার বেটা কয়া গালি দিত। এলা ওমরা ফির ডাকি কথা কয়, আদরও করে।’
তাঁরা যা বলেন: সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা সদস্য রেহেনা আক্তার বলেন, আগে ওই গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। তারা সরকারি ত্রাণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে ধরনা দিত। গ্রামের নারীরাও তাঁদের স্বামীর হাতে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতেন। এখন গ্রামটির চিত্র বদলে গেছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুন নবী বলেন, ‘পাশারীপাড়া গ্রামের নারীরা পরিশ্রমী। তাঁরা সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরি করে যেভাবে বাড়তি আয় করছেন, অন্য এলাকার নারীরাও তাঁদের অনুসরণ করে অনুপ্রেরণা পেতে পারেন।’
রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর Prothom-alo

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons