Total Pageviews

Friday, January 27, 2012

একজন ময়েন স্যার

গোপালগঞ্জ শহরের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ছেন সদস্যরা। বসে আছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মঈন উদ�গোপালগঞ্জ শহরের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ছেন সদস্যরা। বসে আছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মঈন উদ্দিন (ডানে)
ছবি: প্রথম আলো
বই মানুষকে আলোকিত করে। পাঠাগারকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ে জ্ঞানের সেই আলো। এমনই এক পাঠাগার প্রায় ছয় দশক ধরে আগলে রেখেছেন গোপালগঞ্জের ‘ময়েন স্যার’। অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক হিসেবে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজ করছেন অক্লান্তভাবে।
অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষকের পুরো নাম মঈন উদ্দিন। শহরের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সেই ১৯৫৬ সাল থেকে। তাঁর হাত ধরেই বেড়েছে এই পাঠাগারের কলেবর। শহরে গড়ে উঠেছে একটি পাঠক সমাজ। আলোর পরশ পেয়েছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সবার চোখেই নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি আর ‘ময়েন স্যার’ অভিন্ন সত্তা। গোপালগঞ্জের এস এম মডেল স্কুল থেকে ১৯৯০ সালে অবসর নেন মঈন উদ্দিন। কিন্তু পাঠাগারের প্রতি দায়িত্ব শেষ করেননি এই ৭৮ বছর বয়সেও।
দিনলিপি: প্রতিদিন সকালে পাঠাগারের তালা খোলেন মঈন উদ্দিন। সদস্যদের বই দেওয়া থেকে শুরু করে পাঠাগার ঝাড়ু দেওয়ার কাজও করেন। এই পাঠাগারকে ধ্যানজ্ঞান করেই তরুণ বয়স থেকে শুরু করে জীবনের অধিকাংশ সময় পার হয়ে গেছে তাঁর। পরিবারের চেয়েও বেশি সময় তিনি দিয়েছেন এই পাঠাগারে। বই পড়ার অভ্যাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান তিনি। পাঠাগারটি বর্তমানে পরিণত হয়েছে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে।
পাঠাগারে যত বই: নজরুল পাবলিক লাইব্রেরিতে রয়েছে ১৩ হাজার ৯০০ বই ও সাময়িকী। ধ্রুপদি সাহিত্যের বইয়ের মধ্যে রয়েছে হোমারের ইলিয়াড, ওডিসি এবং দান্তে রচনাবলির বাংলা অনুবাদ। আছে পারস্যের কবি ফেরদৌসি রচিত শাহনামা। আছে প্রতীচ্য পুরাণ, রবীন্দ্র রচনাবলি ও নজরুল রচনাবলি। পুরোনো বইয়ের মধ্যে আছে ১৯৫৮ সালের সংস্করণসহ স্ট্যান্ডার্ড জেনারেল নলেজ-এর বিভিন্ন সংস্করণ। রয়েছে রবীন্দ্র রচনাবলির ইংরেজি সংকলন দি গোল্ডেন বুক অব টেগোর (১৯৩১), ফান্ডামেন্টাল রুলস অ্যান্ড সিভিল সার্ভিস রেগুলেশন (১৯৫৭) ও কাজী মোতাহার হোসেনের গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস। পুরোনো সাময়িকীর মধ্যে রয়েছে দি মডার্ন রিভিউ (১৯৩৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত), বিচিত্রা, ভারতবর্ষ, দেশসহ সাপ্তাহিক ও মাসিক বিভিন্ন পত্রিকার ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সংখ্যার বাঁধাই সংস্করণ।
যেভাবে হলো: নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির আদি নাম ছিল করোনেশন লাইব্রেরি। ১৯২০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে ভারতজুড়ে উৎসব উদ্যাপনের আয়োজন করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। এ জন্য ভারতের সব জেলা এমনকি মহকুমা শহরে অর্থ পাঠানো হয়। গোপালগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তখন স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করেন। নাট্যামোদী ১২ সদস্যের আগ্রহে সিদ্ধান্ত হয় একটি থিয়েটার ক্লাব গড়ে তোলার। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় করোনেশন থিয়েটার ক্লাব। সেখানে শহরের সুশীল সমাজের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ একটি পাঠাগার স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ক্লাব পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় করোনেশন পাবলিক লাইব্রেরি। শুরু থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাঠাগারটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন প্রতাপ বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি। এরপর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।
মঈন উদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণ: মা-বাবার অসুস্থতার কারণে সে সময় কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন মঈন উদ্দিন। বই পড়া ও সংগ্রহে অসীম আগ্রহ দেখে তাঁকে সবাই পাঠাগারের দায়িত্ব নিতে বলেন। এভাবেই করোনেশন থিয়েটার ক্লাব ও পাঠাগারের সঙ্গে জড়িয়ে যান মঈন উদ্দিন। সেই থিয়েটার ক্লাবে তখন টিকিটের বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী হতো। এই ক্লাবকে কেন্দ্র করে তখন শহরে গড়ে উঠেছিল ১৮টি ড্রামা ক্লাব ও অনেক পাঠাগার।
পাঠাগারের জন্য ত্যাগ: কলকাতা থেকে এসেছিল বাহারি চাকরির আহ্বান। ‘দ্য ক্যাভেন্ডার্স’ নামে একটি ব্রিটিশ বিপণন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সচ্ছল ভবিষ্যৎ ও বিলাসী জীবনের হাতছানি। কিন্তু পাঠাগারের জন্য তত দিনে বিশেষ মায়া জন্মে গেছে মনে। তাই কলকাতার ডাক উপেক্ষা করলেন মঈন উদ্দিন। কিন্তু জীবন-বাস্তবতা তাঁকে ঠেলে দেয় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তখন এগিয়ে আসেন। মঈন উদ্দিনের চাকরির ব্যবস্থা করেন এসএম মডেল স্কুলে। মাত্র ১০০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। বাকি সময় কাটান পাঠাগারে।
নতুন নামকরণ: পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগ। শহরে তখন মুসলিম লীগ নেতাদের দাপট। তাঁরা করোনেশন পাবলিক লাইব্রেরির নাম বদলে পাকিস্তানের বিশিষ্ট কবি ইকবালের নামে নামকরণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হতে দেননি মঈন উদ্দিন। তিনি বাংলা ভাষার কোনো কবির নামে পাঠাগারের নামকরণের দাবি তোলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করা হয়। ছাত্র-জনতার দাবির মুখে পাঠাগারের নতুন নাম হয় নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি।
পাঠাগারের টিকে থাকা: পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে এক ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় করোনেশন থিয়েটার ক্লাব ও পাঠাগার। তখন পাঠাগারটি তাৎক্ষণিকভাবে স্থানান্তর করা হয় মডেল স্কুল সড়কের একটি টিনের ঘরে। এটি ছিল মঈন উদ্দিনের তৎকালীন বাসস্থানের একটি অংশ। বই ও আসবাবের স্থান সংকুলানের অভাবে পাঠাগারটি সরানো হয় ভাষাসৈনিক পরেশ বিশ্বাসের মধ্যপাড়ার বাড়িতে। কয়েক বছর এভাবেই চলে পাঠাগারের কার্যক্রম। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? স্বপ্নের পাঠাগারের স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন মঈন উদ্দিন। এ ব্যাপারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক শহীদ হামিদ খান। স্থায়ী পাঠাগার স্থাপনের জন্য মাত্র তিন দিনের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ জমির ব্যবস্থা করেন তিনি। মঈন উদ্দিনের সম্বল তখন মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা। ওই টাকায় তিনি একটি টিনের ঘর তৈরির পরিকল্পনা নেন। কিন্তু বাধা দেন মহকুমা প্রশাসক। তিনি সেখানে একতলা ভবন তৈরির পরিকল্পনা করেন। বাজেট ৬০ হাজার টাকা। মঈন উদ্দিনের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এত টাকা কোথায় পাবেন? তখন তাঁকে অভয় দেন হামিদ খান। সরকারি কোষাগার থেকে কিছু টাকার সংস্থান হয়। তৎকালীন ঠিকাদার ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাইদ আলী খানকে এই ভবন নির্মাণকাজের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন হামিদ খান। সাইদ আলী খান রাজি হয়ে যান। এভাবেই নির্মিত হয় নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির বর্তমান ভবন।
একজন ময়েন স্যার: গোপালগঞ্জের খ্যাতনামা এস এম মডেল স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন মঈন উদ্দিন। ফলে এলাকায় তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রচুর। সবার কাছেই তিনি ‘ময়েন স্যার’। আর পাঠাগারের প্রতি আজীবন শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে তিনি অর্জন করেছেন সবার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। ধৈর্যশীল, নীতিবান, অসাম্প্রদায়িক, সদালাপী ও স্বল্পভাষী এই মানুষটি বছরের পর বছর পড়াশোনা করেছেন বহুমুখী বিষয়ে। তাঁর সঙ্গে আলাপ করলেই সেটা বোঝা যায়। সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এই মানুষটি কথা বলেন প্রাণ খুলে। রিকশায় চড়ার বিলাসিতা তাঁর নেই। হেঁটেই চলাফেরা করেন এখনো।
শিক্ষক হিসেবেও ‘ময়েন স্যার’ অতুলনীয়। ছাত্রছাত্রীদের কখনো সাজেশন দেননি। কোনো দিন প্রাইভেট পড়াননি। কোনো দিন ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থ করার জন্য চাপ দেননি।
পরিবারের চোখে: স্ত্রীর নাম জাহান জেব বানু। স্বামীকে নিয়ে গর্বিত তিনি। তাঁদের চার ছেলের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বাবাকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই তাঁদের। শহরের মধ্যপাড়ার একটি বাড়িতে এই পরিবারটির বাস।
প্রত্যাশা: মঈন উদ্দিন এখন খুঁজে ফিরছেন এমন একজন মানুষকে, যিনি এই পাঠাগারটিকে মনে-প্রাণে ভালোবাসবেন। যাঁর হাত ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি সামনের দিকে এগোবে। সে রকম একজনের হাতেই তিনি তুলে দিতে চান পাঠাগারের দায়িত্ব। মঈন উদ্দিন বেঁচে থাকতে চান এই পাঠাগারের মধ্যে, মানুষের পাঠাভ্যাসের মধ্যে। prothom-alo

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons