Total Pageviews

Sunday, June 12, 2011

একটা সাগর কীভাবে হারিয়ে ফেললাম!


undefined
দলপতির আশকারা পেয়েই দলছুট হওয়ার সাহসটা পেয়েছিলাম; বুঝতে পারিনি যে পরিণতি মোটেই সুখকর হবে না। এখন উপকূলটা কোন দিকে, সেটাই আমি ঠাহর করতে পারছি নে। দল ছেড়ে দক্ষিণমুখো হওয়ার সময় মনে হয়েছিল, ম্যাকারনির বাসা দেখে ফিরতি পথে এই ছোট পাহাড়টা ডিঙিয়ে গেলেই উপকূলের নাগাল পাব, তারপর সৈকত ধরে আধাঘণ্টা জোর-কদম হাঁটলে মূল দলকে ধরে ফেলতে পারব। ম্যাকারনির ছবি তুলে বাঁয়ের পাহাড় ছাড়িয়ে আরও দুটো পাহাড় পার হয়েছি; এখন দেখি চারদিকে বরফঢাকা পাহাড় আর পাহাড়, সৈকতের কোনো চিহ্ন নেই। ম্যাকারনির খোঁজে ‘ব্রাউন ব্লাফ’ উপকূল থেকে দক্ষিণে বড়জোর এক কিলোমিটার দূরে গেছি; এখন ফিরতি পথে প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর পানি তো নজরে আসেই নি, ঢেউয়ের শব্দও কানে আসছে না। দলছুট হয়ে দেড় ঘণ্টার মধ্যে একটা আস্ত সাগর আমি কীভাবে হারিয়ে ফেললাম বুঝি নে!
ঘণ্টা দুই আগে আমরা একটা সাদামাটা হিমবাহের শিখরে উঠেছিলাম; সবাই আগ্রহ নিয়ে আজ ট্র্যাকিংয়ে এসেছে হিমবাহ পার হয়ে একটা ফিয়র্ড দেখা আর ১০ হাজার জেন্টু পেঙ্গুইনের বিশাল এক কলোনির ছবি তোলার জন্য। হিমবাহ থেকে নেমে সবাই বাঁয়ে মোড় নিয়ে ফিয়র্ড দেখতে যাবে, তারপর সৈকত ধরে ট্র্যাকিং করবে জাহাজের দেখা না পাওয়া পর্যন্ত। হিমবাহ থেকে নেমে আর সবার মতো উত্তরমুখো না হয়ে দক্ষিণে এগিয়ে গেলে ১৫ মিনিট পর একডজন ম্যাকারনি পেঙ্গুইনের একটা খুদে কলোনি দেখা সম্ভব—এই সংবাদটা গোপনে আমাকে দিয়েছিল ল্যারি হব্স। ল্যারি আমাদের এক্সপেডিশন-লিডার, অনেক অভিযাত্রীর দেখভালের গুরুদায়িত্ব তার কাঁধে; কিন্তু এর চাপে ল্যারির রসজ্ঞান মোটেই লোপ পায়নি। দল থেকে সরে এসে সে বলল, ‘বরফের মরুভূমিতে আধাঘণ্টা একা হাঁটার সাহস থাকলে তোমাকে বিরল ম্যাকারনি পেঙ্গুইনের ছবি তোলার পথ বাতলে দিতে পারি। হিমবাহ থেকে নেমে ডান দিকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই একটা বরফমুক্ত ঢিবির ওপর একটা ছোট্ট ম্যাকারনি-কলোনি থাকার কথা, আমি গত বছর পেয়েছিলাম। ব্রেন্ট হিউস্টনকে জেন্টু পর্যবেক্ষণে যেতে হবে, তোমার সঙ্গ দিতে পারবে না। আশা করি একা গিয়ে ফিরে আসতে পারবে, না পারলে অভিযান-ডিরেক্টর জাহাজের মাস্তুলে আমাকে উল্টো লটকে রাখবে। ওই ভদ্রমহিলার তো সেন্স অব হিউমার বলে কিছু নেই।’
ল্যারি জানে, অ্যান্টার্কটিকার নয় প্রজাতির পেঙ্গুইনের সবগুলো দেখার পণ করে আমি এই সফরে এসেছি, অন্যদের মতো দু-এক জাতের নয়-দশ লাখ পেঙ্গুইন দেখেই খুশি হয়ে ফিরে যেতে চাই নে। বিরল ও বিপন্ন ম্যাকারনি পেঙ্গুইন দেখতে পাওয়া আমার কাছে এক কোটি অ্যাডেলি অথবা জেন্টু পেঙ্গুইন দেখার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। ল্যারির কথা, বরফে পড়ার আগেই আমি দলছুট হতে রেডি, পা চালিয়ে সবার আগে হিমবাহ থেকে নেমে হোয়াইট-আউটের আড়ালে ডান দিকে সটকে পড়লাম। দুরু দুরু বুকে ১৫ মিনিট চলার পর সত্যি সত্যি এক ম্যাকারনি কলোনি পেয়ে গেলাম, বিলুপ্তির ক্ষণ গুনতে থাকা এই পাখিদের প্রাণভরে দেখলাম, ছবি তুললাম, তারপর দ্রুত পায়ে ফিরতি পথ ধরলাম। সবই ঠিকঠাক চলত, যদি উপকূলটা দেখতে পেতাম। তুষার আর জলীয়বাষ্প দিয়ে চারদিক হোয়াইট-আউট, দূরে দৃষ্টি চলে না। প্রমাদ গুনলাম, প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর যখন পাহাড় শেষ হলো না, বুঝলাম আমি পথ হারিয়েছি। নিজেকে তো বটেই, ল্যারিকেও না জানি কী বিপদে ফেললাম। এখন কোন দিকে পা চালাতে হবে তা কে বলে দেবে, চারদিকই সমান ধলা!
হঠাৎ শুনি, পেছন থেকে যেন কেউ বলছে, ‘টার্ন ব্যাক, টার্ন ব্যাক।’ দৈববাণী শুনলাম কি! না, হোয়াইট-আউট ভেদ করে দেখি বেরিয়ে আসছে এক দীর্ঘদেহী অভিযাত্রী—ব্রেন্ট হিউস্টন। তুষার ভেঙে থপ থপ করে দৌড়ে কাছে গেলে সে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ বলো তো? ওদিকে গেলে দুই দিন পর ওয়েডেল সাগরে পৌঁছে যাবে, আমরা তদ্দিনে এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে চলে যাব। ভাগ্যিস, ল্যারি আমাকে এদিকে পাঠিয়েছিল। তোমার জন্য আমার ভালো ম্যারাথন দৌড় প্র্যাকটিস হয়ে গেল।’

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons