Total Pageviews

Saturday, June 11, 2011

‘এভারেস্টের চূড়া দেখতে পাবে’


undefinedস্বপ্ন নিয়ে পাতায় এভারেস্ট বিজয়ের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন মুসা ইব্রাহীম। আসুন, তাঁর কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাক এই দুঃসাহসিক অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।
প্রথম পর্বের পর
কৈলাসের কথা শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। কান গরম হয়ে উঠল। আবারও জেদ চেপে গেল। দাঁতে দাঁত কামড়ে আগুন চোখে কৈলাসের দিকে তাকালাম। এরপর ঘাড় ফেরালাম আরও ডানে। এবার চার-পাঁচটা পুরোনো রোপ দৃষ্টিসীমায় এল। সেটা কিছুটা ডানে সরে গিয়ে পাকড়ালাম এবং আগের মতো বাঁ হাতে জুমার ঠেলে এবং ডান হাতে রোপ আঁকড়ে ধরে সেই ওভারহ্যাং ট্র্যাভার্স করতে শুরু করলাম।
বিধি বাম। ২০ সেকেন্ডের চেষ্টায় সেই ওভারহ্যাং পাশ কাটালাম ঠিকই। পিঠে ব্যাগপ্যাকের ভেতর অক্সিজেন বোতল রেখে রেগুলেটরটা বাইরে রেখেছিলাম, যাতে সহজেই বোতলে অক্সিজেনের পরিমাণ এবং অক্সিজেন প্রবাহ পরীক্ষা করা যায়। সেই রেগুলেটরের সঙ্গে যুক্ত রাবার পাইপ, যা বোতল থেকে অক্সিজেন মাস্কে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায়—ঠিক ওপরের দিকে ফুটো হয়ে গেল ওভারহ্যাং রক ফেসে ঘষা খেয়ে। শশশশশশ। একটানা শব্দ হচ্ছে। অক্সিজেন বের হয়ে যাচ্ছে ফুটো পাইপ দিয়ে, ফুসফুসে যাচ্ছে শুধু সাধারণ বাতাস। যাতে অক্সিজেনের পরিমাণ মাত্র ৩৩ শতাংশ।
এতক্ষণ জীবন বাজি রেখে সেই ওভারহ্যাং পার হয়ে এলাম ঠিকই। কিন্তু বুক দ্বিগুণ বেগে হাপরের মতো ওঠানামা করছে। আর পাইপ ফুটো হয়ে যাওয়ায় সেই হাপর মনে হলো এখনি ফেটে যাবে—ভেতরে বাতাস নেই ঠিকই, কিন্তু বাইরের বাতাসের চাপে। বাতাস নাক-মুখ দিয়ে ফুসফুসে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পর্যাপ্ত অক্সিজেন না থাকায় মনে হলো মরে যাচ্ছি। সেই রক ফেসের ওপর দুই হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাস্কের ভেতর মুখ হাঁ করে অক্সিজেন পাওয়ার চেষ্টা করছি। পারছি না, পারছি না। মরে যাচ্ছি, আর মনে হয় হলো না।

ভাগ্যিস কৈলাস আমার পেছন পেছন উঠছিলেন। তাঁর পেছনে আরেক গ্রুপের শেরপা খাত্রা দর্জি। তাঁরা ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। শোঁ-শোঁ শব্দ শুনে খুঁজে বের করলেন ফুটো। এবার সেই ফুটোর সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন রেগুলেটর। মুহূর্তের মধ্যে শরীরে অক্সিজেন পৌঁছাল। ফুসফুস ভরে অক্সিজেন টেনে নিলাম। হাহ্! বেঁচে গেলাম তাহলে। করমর্দন করে পিঠ চাপড়ে দিলাম তাঁদের।
‘কৈলাস, ধন্যবাদ। ধন্যবাদ খাত্রা দর্জিজি।’
‘আরে, চিন্তা কোরো না। আমরা তোমার সঙ্গেই আছি।’
খাত্রা দর্জি আর কৈলাসের মিলিত উত্তর।
মাথায় ফ্লিস কাপড়ের ‘মাঙ্কি ক্যাপ’, তার ওপর হেডল্যাম্প আর আপাদমস্তক ডাউন জ্যাকেটের ক্যাপ এবং মুখে অক্সিজেন মাস্ক—সব মিলিয়ে দুই চোখ বাদ দিলে মুখের খুব কম অংশই বাইরের আবহাওয়ার সরাসরি সংস্পর্শে আসছে। শুরুর দিকে তো কোনো বাতাস ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এ পর্যায়ে হালকা চিরচির বাতাস বইছে। চোখ হিম হয়ে আসছে। সেই চিরচির বাতাসে যখনই একটু বাড়তি গতি, বারবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। ফলে টানা হাঁটায় চার-পাঁচ সেকেন্ডের বিরতি পড়ছে বারবার। এই বিরতির কারণ আর শেরপাদের ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হচ্ছে না, তাঁরাও একই সমস্যার মধ্যে আছেন।
‘হেই কৈলাস।’
‘বলো।’
‘সামিট কত দূরে? আর কতক্ষণ লাগবে?’
‘ক্লাইম্ব করো বন্ধু, ক্লাইম্ব করো। একটু পরে, সময় হলেই সামিটের দেখা পাবে।’
আমার আর কৈলাসের মধ্যে চলছে কথাবার্তা। শেষ হতেই আবার ক্লাইম্বিং শুরু হলো। সামনে তাকিয়ে দেখি লাকপা নেই। সে কিছুটা এগিয়ে গেছে। তবে খুব বেশি নয়। মিনিট তিনেক এগোতেই দেখি সে রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কৈলাস তাঁকে পুুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করলেন। দূরের রিজে আরোহীরা এভারেস্টের চূড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের হেডল্যাম্প দেখে মনে হয় আকাশের গায়ে তারা হেঁটে বেড়াচ্ছে।
এরপর একটানা ক্লাইম্বিং। একবার রিজের একেবারে মাথা ধরে কিছুটা এগোলাম। তখন চোখের কোণে ধরা পড়ল কেমন খাড়া পর্বতের রিজ ধরে আমরা এগোচ্ছি। এক ঝলক তাকিয়েই সামনের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বাপ রে! কোনো অ্যাংকর তো নেই, পড়লে মুহূর্তেই কয়েক হাজার ফুট নিচে। বুক হিম হয়ে আসে, গা গুলিয়ে ওঠে।
আধঘণ্টা পর আরেকটা রিজের ধারে হাজির হতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। একটা মৃতদেহ। বইতে পড়েছিলাম, এভারেস্টে আরোহণে নেপাল বা তিব্বতের রুটে বহু মৃতদেহ পড়ে থাকে। কিন্তু সেটা যে এভাবেই দেখতে হবে, তা কখনো চিন্তা করিনি।
বিষয়টা নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে আবারও একটানা ক্লাইম্বিং করে চলেছি। ততক্ষণে ঘণ্টা দুয়েক আগেই চাঁদ দিগন্তে ডুবে গেছে। এবং বহুক্ষণ ধরেই কৈলাসের হেডল্যাম্পের আলোয় ক্লাইম্বিং করছি। ফলে নিজের হেডল্যাম্পের আলো যে অনেকটা মিইয়ে এসেছে, তা আর টের পাচ্ছি না। ব্যাপারটা টের পেলাম একটা রক ফেস ট্র্যাভার্স করতে গিয়ে।
‘মুসা। এটাই সর্বশেষ রক ফেস, যেটা তোমাকে ক্লাইম্ব করতে হবে। এটা পার হলেই তুমি এভারেস্টের চূড়া দেখতে পাবে।’

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons