Total Pageviews

Sunday, July 10, 2011

ঢাকার প্রথম মুসলিম নারী চিত্রশিল্পী

  • ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত মেহের বানু খানমের আঁকা ছবি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত মেহের বানু খানমের আঁকা ছবি
  • ছবি আঁকছেন শিল্পী মেহের বানু খানম ছবি আঁকছেন শিল্পী মেহের বানু খানম
1 2
মোসলেম ভারত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আফজালুল হক দুটি ছবি সংগ্রহ করেছেন ঢাকা থেকে। ছবি দুটি এঁকেছেন ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারের নওয়াবজাদি মেহের বানু খানম। পত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছবি দুটি ছাপবেন তিনি।
ছবি দুটির পরিচিতি লিখে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। কবি ছবি দেখে মুগ্ধ। পরিচিতি না লিখে লিখলেন কবিতা। দুটি ছবির একটি তাঁর মনে যে ভাবের জন্ম দেয়, তারই ফসল ‘খেয়াপারের তরণী’ নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কবি নজরুলের বন্ধু মুজফ্ফর আহমেদ লিখলেন, ‘এই কবিতাটিকে ঘিরে যে আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা একান্তভাবে বেগম সাহেবারই।’
একটি ছিল নদী পারাপাররত নৌকার ছবি এবং অন্যটি বিক্রমপুরের একটি গ্রামের দৃশ্য। যেহেতু নজরুল লিখলেন কবিতা, তাই ওই চিত্র দুটির পরিচিতি লেখার দায়িত্ব বর্তাল সেকালের বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলীর ওপর। বেগম সাহেবার দুটি চিত্র ও নজরুলের কবিতা এবং এমদাদ আলীর চিত্র-পরিচয় নিয়ে ১৯২০ সালের আগস্টে অর্থাৎ বাংলা ১৩২৭ সালের শ্রাবণ মাসে কলকাতায় মোসলেম ভারত-এর আলোচিত সংখ্যাটি বের হলো। নদী পারাপাররত ছবিটি রঙিন এবং অপরটি সাদাকালো। অন্য পাতায় কবির পরিচয় ‘হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম’ আর তাঁর কবিতা ‘খেয়াপারের তরণী’ ছাপা হলো। ‘যাত্রীরা রাত্তিরে হ’তে এল খেয়া পার,/ বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জ্জেছে কে আবার?/ প্রলয়েরি আহ্বান ধ্বনিল কে বিষাণে/ ঝঞ্ঝা ও ঘন দেয়া স্বণিল রে ঈশানে!’ ৩০ লাইনের কবিতাটি এভাবেই শুরু হয়েছিল।
ইমদাদ আলী দুটি ছবি নিয়েই বিস্তারিত লিখলেন, যার কিছুটা উল্লেখ করছি। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম চিত্র: ইহা একখানি ধর্মচিত্র। পাপের নদী উত্তাল তরঙ্গে ছুটিয়া চলিয়াছে। এই নদীতে কান্ডারীহীন গোমরাহীর তরণী আত্মরক্ষা করিতে না পারিয়া আরোহীসহ নিমজ্জিত হইতেছে। তাহার হালের দিকটা মাত্র ডুবিতে বাকি আছে। তাহার উদ্ধারের কোন আশা নাই। কিন্তু যাহারা তাওহিদের তরণীতে আশ্রয় লইয়াছেন, তাহারা বাঁচিয়া আছেন, কারণ এই তরণীর কর্ণধার হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স.)। তাহার চারি প্রধান আসহাব এই তরণীর বাহক।
‘দ্বিতীয় চিত্র: পল্লী দৃশ্য। বিক্রমপুরের উত্তর দিকে তালতলা একটি বন্দর। এই বন্দরের পূর্ব দিকের যে গ্রামখানি নদী তীরে বিস্তৃত রহিয়াছে, চিত্রে তাহাই অংকিত হইয়াছে।
‘মৃদুল বায়ু হিল্লোলে নদী বুকে যে তরঙ্গের লীলা আরম্ভ হইয়াছে চিত্রে তাহা বড়ই সুন্দর করিয়া অঙ্কিত হইয়াছে। আলো ও ছায়ার সুসমাবেশে উহা কি মনোরমই না দেখাইতেছে।’
প্রায় শত বছর আগে একজন নারীর, তা-ও আবার রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার থেকে চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। তখন রক্ষণশীল ধ্যানধারণা পোষণের ফলে বিশেষ করে নারীদের সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রটি ছিল রুদ্ধ।
সাধারণ নিয়মানুযায়ী ঢাকার নবাববাড়ির মেয়েদের অন্দরমহলই ছিল একমাত্র ঠিকানা। কিন্তু শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা যদি একবার সত্তায় জেগে ওঠে, তবে তাকে অবদমন করা সত্যিই কঠিন। আর তাই রক্ষণশীল পরিবার ও সমাজের বাধা অতিক্রম করে নিজেকে চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন মেহের বানু খানম।
ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহর কন্যা মেহের বানু খানমের (নবাব সলিমুল্লাহর ছোট বোন) মায়ের নাম ছিল কামরুন্নেসা খানম। মেহের বানুর জন্ম কবে, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। লেখক অনুপম হায়াৎ অনুমান করেন, তাঁর জন্ম ১৮৮৫-৮৮ সালের মধ্যে। হায়াৎ তাঁর পুরনো ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘তাদের বাড়িতে ছিল দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা চিত্র শিল্পীর আঁকা ছবির সংগ্রহ। ছিল অনেক সচিত্র বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা। তিনি এখান থেকেই অঙ্কন চর্চা শুরু করেন। তবে তাঁর অঙ্কন চর্চায় কখনো কোনো জীবজন্তুর অস্তিত্ব থাকতো না। তিনি সব সময়ই প্রকৃতি ও ইসলামের ধর্মীয় চেতনাকে তাঁর শিল্পসত্তায় ধরে রাখতেন।’
দুঃখজনক বিষয় হলো, মোসলেম ভারত-এ প্রকাশিত ছবি দুটি বাদে মেহের বানুর আঁকা আর কোনো ছবি এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে মেহের বানুর চিত্রাঙ্কনরত অবস্থার একটি আলোকচিত্র পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, তিনি ইজেলের ওপরের দিকে সেঁটে রাখা একটি চিত্রের অনুকরণে ঠিক নিচেই আরেকটি কাগজে ছবি আঁকছেন। লক্ষ করলে বোঝা যায়, এটি নদীতে একটি নৌকার দৃশ্য। আলোকচিত্রে দৃশ্যমান চিত্রটি এবং প্রকাশিত অন্য চিত্র দুটি বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে তিনি ‘ল্যান্ডস্কেপ’ই বেশি আঁকতেন। এই তিনটিই নদীর দৃশ্য। সুতরাং নদী ও নৌকা, সম্ভবত, তাঁর আঁকা ছবিতে বারবার এসে থাকবে। এ সবই অনুমান মাত্র। মেহের বানুর আরও ছবি পাওয়া গেলে তাঁর ছবির বিষয় ও মান সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হওয়া সম্ভব হবে।
সম্ভবত, ১৯১২-১৩ সাল থেকে মেহের বানু ছবি আঁকা শুরু করেন। মেহের বানুর বিয়ে হয় ২৫ পৌষ ১৩০৮ বাংলা সালে অর্থাৎ ১৯০২ সালে। তাঁর স্বামী খাজা মোহাম্মদ আজম ছিলেন একজন সাহিত্যিক এবং ঢাকার পঞ্চায়েত সরদারদের তত্ত্বাবধায়ক। ঢাকার ওপর একটি উল্লেখযোগ্য বই দ্য পঞ্চায়েত সিসটেম অব ঢাকা তাঁরই লেখা। এ জন্য সংস্কৃতিমনা স্বামীর কাছ থেকে মেহের বানু শিল্পসাধনায় সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
এই সংস্কৃতিমনা পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরাও ঢাকার ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সেই সময়ে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তাঁর এক ছেলে খাজা মোহাম্মদ আদিল ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক ও জাদু পত্রিকার সম্পাদক। খাজা আদিল ও তাঁর ভাই খাজা আজমলের উদ্যোগে ঢাকায় ১৯২৯-৩১ সালে ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস ও সুকুমারী নির্মিত হয়। দ্য লাস্ট কিস-এর নায়ক ছিলেন খাজা আজমল নিজেই।
মেহের বানু খানম ১৯২৫ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে দিলখুশা মসজিদের পূর্ব পাশে নবাব পরিবারের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনিই ঢাকার প্রথম নারী চিত্রশিল্পী।
প্রথম আলো

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons