Total Pageviews

Sunday, March 25, 2012

বাড়তি জমির সবুজ ফসল

মেঘনার মাঝে জেগে ওঠা চর। সবুজ ফসলে খুশির ঝিলিক কৃষকের মুখে মেঘনার মাঝে জেগে ওঠা চর। সবুজ ফসলে খুশির ঝিলিক কৃষকের মুখে
ছবি: প্রথম আলো
ভোলার ইলিশা বিশ্বরোডের মাথা থেকে ইঞ্জিনের নৌকা ছাড়ল। চারদিকে পানি, ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন নীলাকাশ, দেশি-বিদেশি পাখির ওড়াউড়ি। চরগুলোকে দূর থেকে কালোরেখা মনে হয়। কাছে গেলে রং পাল্টে হয় সবুজ।
দুই পাশে ফসলের খেত। মাঝখানে স্রোতোস্বিনী খাল। বড় বড় ট্রলার সে খালে দাঁড়িয়ে সবজি-তরমুজ তুলছে। ঢাকাগামী ট্রলার-মালিক ও চালক মিজানুর রহমান বললেন, এখন আর বাজারে গিয়ে ফসল বিক্রি করতে হয় না। এখানে থেকেই ফসল বিক্রি করা যায়।
বছর পঞ্চাশ আগে ভোলা-গাজীপুর সড়কে চলত লম্বা নাকওয়ালা, হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে চালু করা বাস। সেই গাজীপুর ইউনিয়ন বহু আগেই বিলীন হয়েছিল মেঘনা নদীতে। বছর পাঁচেক আগে মেঘনার মাঝে গাজীপুর ও তার আশপাশের কিছু অংশে আবার চর জেগে উঠেছে। এই বাড়তি চরাঞ্চল এখন ভরে উঠেছে সবুজ ফসলে।
চর আর চর
ভোলার শুরু রাজাপুর ইউনিয়ন দিয়ে। চলমান নৌকায় দাঁড়িয়ে দেখা যায়, মেঘনার মাঝে চর আর চর। নৌকার সঙ্গী রাজাপুরের বাসিন্দা আমির হোসাইন জানান, ভাঙনের কয়েক বছরের মধ্যে মেঘনার মাঝে সদর উপজেলাতেই গাজীপুর চর, কালুপুরা চর, খরকির চর, বারাইপুর, রামদেবপুরসহ ১০-১২টি চর জেগে উঠেছে। দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, তজুমদ্দিন, লালমোহন, চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা ৫৫টি চরে প্রতিবছর রবি মৌসুমে আবাদ হচ্ছে লক্ষাধিক একর জমি।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যায়, ভোলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ১৯৭৩-২০০০ সাল পর্যন্ত নদীগর্ভ থেকে বাড়তি জমি পাওয়া গেছে ৫০ হাজার ৮০০ হেক্টর। নদী ভেঙেছে ৮৩ হাজার ৩৬৬ হেক্টর। আর চর পড়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ১৬৮ হেক্টর। এ চর পড়ছে জলস্রোতে ভেসে আসা পলি থেকে।
সবুজ চরাঞ্চল
মেঘনার মাঝে সবুজ আর সবুজ। ইলিশা বিশ্বরোডের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম জানান, বর্ষায় মেঘনা থাকে উত্তাল। উত্তর থেকে ঘোলাপানির সঙ্গে পলি ভেসে এসে জমে এসব চরের জমিতে। জমি হয় উঁচু ও উর্বর। কম সারেই ফলন হয় ভালো। এসব চরে রবি মৌসুমে চাষ হচ্ছে বোরো ধান, বাঙ্গি, তরমুজ, আলু, ডাল, বাদাম, মরিচ, সয়াবিন, করলা, চিচিঙ্গা, লাউ, কুমড়া। আর বর্ষায় হয় বোনা আমন।
গাজীপুর চরে নামতেই যেন তরমুজের লতায় পা জড়িয়ে যায়। মাইলের পর মাইল ফসলি খেত। চরের কৃষক হাজি ফারুক হোসাইন জানান, তিনি গত তিন বছর এ চরে সবজির চাষ করছেন। এ বছর তরমুজ, করলা, চিচিঙ্গা, মরিচ ও বোরো ধান লাগিয়েছেন। গাজীপুর চরে শাহজল হাজি চাষ করেছেন ১৩ একর জমিতে। তিনি জানান, মেঘনার মাঝে জেগে ওঠা চরে বোরো আবাদই করতেন কৃষকেরা। এখন ধানের পাশাপাশি বাঙ্গি, তরমুজ, আলু, ডাল, বাদাম, মরিচ, সয়াবিন, সবজি চাষও হচ্ছে প্রচুর।
রবি ও খরিফ-১ মৌসুমে চাষাবাদ করে কৃষক বাম্পার ফলন পাচ্ছেন। বিক্রিতেও সমস্যা নেই। বেপারি এসে নৌকাভরে ফসল কিনে নিচ্ছেন।
ভোলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শান্তি রঞ্জন মণ্ডল প্রথম আলোকে জানান, মেঘনা-তেঁতুলিয়ার মাঝে জেগে ওঠা চর উর্বর। এখানে বাম্পার ফলন হচ্ছে। prothom-alo

Friday, March 23, 2012

গরিবের সহায় সাথী আপা

দিনাজপুরের চিবিরবন্দর উপজেলার সাতনালা গ্রামে কর্মীদের সঙ্গে নকশিকাঁথার কাজ করছেন সাথী দিনাজপুরের চিবিরবন্দর উপজেলার সাতনালা গ্রামে কর্মীদের সঙ্গে নকশিকাঁথার কাজ করছেন সাথী
প্রথম আলো
বাঙালি গৃহবধূ বলতে চট করে আমাদের চোখের সামনে নারীর যে চেহারা ফুটে ওঠে তা থেকে তিনি আলাদা। বাঙালি নারীর মতোই তিনি সহজ-সরল ও মার্জিত। তবে তাঁর কিছু বিশেষ গুণ আছে। তিনি সংগ্রামী, পরোপকারী এবং পরিশ্রমী। পরিশ্রম করে শুধু নিজেরই নয়, ৬০০ দরিদ্র নারীর সংসারের অভাব দূর করেছেন, দেখাচ্ছেন সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
এই গৃহবধূর নাম শামীমা আক্তার সাথী। সবার কাছে তিনি প্রিয় সাথী আপা। মেয়েদের পোশাক তৈরি দিয়ে শুরু পথচলার। পরে কাঁথা ও শিশুদের পোশাকে সুঁই-সুতা দিয়ে নকশার কাজ করে নজর কেড়েছেন সবার। প্রায় দিনই ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েন। কাজ নিয়ে ছুটে চলেন রংপুরের তারাগঞ্জ, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, খানসামা ও নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আবার ফেরেন বাড়িতে। দরিদ্র নারীদের দুঃখ ঘোচাতে এ যেন তাঁর ভিন্ন এক আন্দোলন।
শুরুর কথা: সৈয়দপুর উপজেলার সোনাখুলি গ্রামের শামসুদ্দিনের মেয়ে সাথীর বিয়ে হয় ১৯৯৮ সালে সৈয়দপুর শহরের পুরাতন বাবুপাড়া মহল্লার শামসুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে। বিয়ের সময় এই দম্পতি ছিল বেকার। শ্বশুরবাড়িতে সাথীর মনে হলো, বেকার জীবন সম্মানের নয়। তাই তিনি স্বামীকে ঢাকায় গিয়ে চাকরির সন্ধান করতে উদ্বুদ্ধ করেন। স্নাতক পাস সাথী নিজেও চাকরি খোঁজেন হন্যে হয়ে।
ঢাকায় স্বামী একটা চাকরি জোটালেও বেকারই থাকতে হলো সাথীকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। বাবার বাড়িতে মায়ের কাছে শিখেছিলেন সুঁই-সুতার কাজ। সেটা কাজে লাগিয়ে মেয়েদের পোশাক তৈরির জন্য একটি দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নেন। ভাবলেন, এখানে তৈরি করা পোশাক হবে আলাদা, যাতে থাকবে সুঁই-সুতার কাজ। পোশাকে ফুটে উঠবে প্রকৃতি, রূপকথা, দেশসহ নানা আকর্ষণীয় নকশা।
এই ভাবনা থেকেই ২০০০ সালে নিজ বাড়ির একটি কক্ষে দুটি সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু হয় কাজ। পুঁজি ছিল স্বর্ণালংকার বিক্রির ৫০ হাজার টাকা। বাড়ির একটি কক্ষে পোশাক বিক্রির জন্য ছোট একটি দোকান করেন, নাম দেন ‘লাল সবুজ’। ধীরে ধীরে এই পোশাকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। আয় ও ব্যবসার পরিধি বেড়ে যাওয়ায় সৈয়দপুর শহরের গ্যারিসন সিনেমা হল সংলগ্ন ক্যান্টনমেন্ট মার্কেটে বিক্রয়কেন্দ্র খুললেন। এর পাশেই রয়েছে একটি কারখানা।
নকশিকাঁথা: ২০০৬ সালে হঠাৎ করে সাথী নকশিকাঁথা তৈরির প্রস্তাব পান। এ কাঁথা তৈরিতে সময় ও শ্রম বেশি লাগে, আয়ও হয় বেশি। এ কারণে এ কাজের সঙ্গে গ্রামের দরিদ্র ও অভাবী পরিবারের নারীদের যুক্ত করার চিন্তা করেন সাথী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে নারীদের কাঁথা তৈরির কাজ শেখান। প্রকারভেদে একটি কাঁথা তৈরিতে তিন হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এসব কাঁথা দেশ-বিদেশে পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়ও বিক্রি হয়। গুণেমানে ভালো হওয়ায় সাথীর নকশিকাঁথার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। প্রসার বেড়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালে স্বামীকে ঢাকা থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন সাথী।
৭০০ মানুষের কর্মসংস্থান: সাথী আপার প্রতিষ্ঠান লাল সবুজে এখন ৭০০ দরিদ্র মানুষ কাজ করে। এদের ৯০ ভাগই নারী। এখানে নকশিকাঁথার কাজ বেশি হয়। পাশাপাশি মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, শিশুদের ফ্রক, থ্রি-পিছ, ফতুয়া, পাঞ্জাবিও তৈরি করা হয় তাঁর কারখানায়। প্রত্যেক নারীকর্মী প্রতি মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করেন।
কর্মীদের কথা: লাল সবুজে কাজ করে সংসারের অভাব দূর করেছেন সাবিনা বেগম, রেহানা পারভিন, গুড়িয়া বেগমের মতো অনেক অসহায় ও দরিদ্র নারী। গুড়িয়া বেগম জানান, চার বছর আগে তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। এক ছেলেকে নিয়ে বিপদে পড়েন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে সাথী তাঁকে কাজ দেন। এখন মাসে চার হাজার টাকা আয় করছেন।
সাথীর স্বপ্ন: তিনি ভবিষ্যতে সৈয়দপুর শহরে একটি বড় পোশাক কারখানা করতে চান। সেখানে দরিদ্র নারী ও কিশোরীরা কাজ করবে। সংসারের খরচ জোগাতে পুরুষদের সহায়তা করার জন্য তিনি নারীদের স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী করতে চান।
সংশ্লিষ্টদের কথা: সৈয়দপুর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোসলেম উদ্দিন জানান, কী করে ছোট্ট একটি সুঁই-সুতার কাজ বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়ে উঠতে পারে তা সাথীর কাছে শিখতে হবে। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা সাবিকুন্নাহার বলেন, ‘সাথী দরিদ্র নারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। আমরা তাঁকে সাধ্যমতো সহায়তা করব।’

Tuesday, March 13, 2012

কাজের কাজি সুমাইয়া

  • সুমাইয়া আন্দালিব কাজি সুমাইয়া আন্দালিব কাজি
  • সিএনএন-এ সাক্ষাত্কার দিচ্ছেন সুমাইয়া আন্দালিব কাজি সিএনএন-এ সাক্ষাত্কার দিচ্ছেন সুমাইয়া আন্দালিব কাজি
1 2 3
বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রভাবশালী ৫০ উদ্যোক্তার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক তরুণী। নাম তাঁর সুমাইয়া কাজি। সম্প্রতি রয়টার্স ও ক্লাউট ওয়েবসাইট জগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০ উদ্যোক্তার যে তালিকাটি প্রকাশ করে, সেখানে ১৬ নম্বরে আছেন সুমাইয়া।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ও ক্লাউট সম্প্রতি বিশ্বের সেরা ৫০ উদ্যোক্তার যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সে তালিকায় ১৬ নম্বরে স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সুমাইয়া আন্দালিব কাজি। তবে ভাবার কারণ নেই, এটিই সুমাইয়ার সাফল্যের শুরু। সুমাইয়ার সাফল্যের শুরু বরং অনেক আগে, সেই ২০০৬ সালে। সে বছর বিজনেস উইক ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিল অনূর্ধ্ব ২৫ বছর বয়সী সেরা উদ্যোক্তাদের এক তালিকা। সে তালিকাতেও সগৌরবে স্থান করে নেয়েছিলেন সুমাইয়া। পেয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অভিনন্দন। এ ছাড়া একই বছর উইক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিশ্বসেরা ৭৫ নারী উদ্যোক্তার মধ্যেও ছিলেন তিনি। পেয়েছেন সিএনএনের ‘ইয়ং পারসন হু রকস’ এবং কালার লাইট ম্যাগাজিনের সেরা তরুণ উদ্যোক্তা পুরস্কার। কিন্তু সুমাইয়ার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। তখন ২০০৫ সাল। সুমাইয়া সবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে থেকে মার্কেটিং অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক প্ল্যানিং বিষয়ে উচ্চতর পড়ালেখা শেষ করে যোগ দিয়েছেন সানমাইক্রোসিস্টেমে সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে। পাশাপাশি শুরু করেছেন ‘কালচারাল কানেক্ট ডট কম’ (টিসিসিসি) নামের একটি অনলাইন মিডিয়া প্রতিষ্ঠার কাজ। এ প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি প্রকাশ করতে শুরু করেন সাপ্তাহিক ‘দ্য দেশি কানেক্ট’, ‘দ্য মিডলইস্ট কানেক্ট’, ‘দ্য লাতিন কানেক্ট’, ‘দি এশিয়া কানেক্ট’ ও ‘দি আফ্রিকান কানেক্ট’ নামের পাঁচটি অনলাইন ম্যাগাজিন। সময় গড়ায় আর সুমাইয়ার এ ম্যাগাজিনগুলোর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব ম্যাগাজিনের রয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার।
তবে এর মাঝেই সীমায়িত নয় সুমাইয়ার জগৎ। নিজের কর্মজগৎ বিস্তৃত করতে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুমাজি ডট কম’ (www.sumazi.com)
নামের আরেকটি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক মূলত সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য খুঁজে পেতে সহায়তা করে। অল্প সময়ের মধ্যে এই ওয়েবসাইট এতই জনপ্রিয় হয়েছে যে সুমাইয়াকে দুটি দেশের আটটি অঙ্গরাজ্যের ১৮ সিটিতে স্থাপন করতে হয়েছে আলাদা অফিস। ‘বাংলাদেশেও সুমাজি ডট কমের কার্যক্রম সম্প্রসারণের ইচ্ছা আছে আমার। আশা করছি, এর মাধ্যমে অলাভজনকভাবে শিক্ষা, দুর্যোগ, চাকরিপ্রাপ্তি ও বিভিন্ন পরামর্শের ক্ষেত্রে উপকৃত হবে অনেকেই।’ ইউনাইটেড নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডট কমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন সুমাইয়া।
শুরু থেকেই নিজের কাজের ওপর আস্থা থাকায় নিজের দলের সদস্যদেরও অনুপ্রাণিত করতে পেরেছেন সুমাইয়া। টেকক্রান্সের একটি কাজ দ্রুত এবং দারুণভাবে সম্পন্ন করার পর পেয়ে যান নিউজ এজেন্সি অমিদইয়ার নেটওয়ার্ক অ্যাওয়ার্ড। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ইকোনমিক ফোরামে আমন্ত্রিত হয়ে নারী উদ্যোক্তা বিষয়ে বক্তব্য দেন তিনি। এসব কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে মানবাধিকার, পরিবেশ, শিক্ষা, রক্তদানসহ নানা ধরনের স্বেচ্ছাসেবী কাজের সঙ্গেও যুক্ত আছেন প্রায় ১০ বছর ধরে। প্রতি সপ্তাহে একদল উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীর পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসার আইডিয়ার বিষয়ে দিচ্ছেন পরামর্শ। এক সময়ে চাকরি করা প্রতিষ্ঠান সান মাইক্রোসিস্টেম সুমাইয়াকে ‘সারা বিশ্বের সেরা ২৫ স্বেচ্ছাসেবক’ তালিকার একজন নির্বাচিত করে। নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার শুরুতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন তিনজন কর্মী, যা বর্তমানে অর্ধশতাধিক হয়েছে। এখন স্বপ্ন দেখছেন আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।

২.
সুমাইয়া কাজির পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের ফেনী জেলায়। তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে। তবে কর্মসূত্রে এখন বসবাস করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোতে। বাবা ড. নিজাম উদ্দিন কাজি, মা মেরিনা কাজি। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সুমাইয়ার অবস্থান শীর্ষে। এখনো বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি সুমাইয়া। অবসর কাটে কীভাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কাজই আমার অবসর।’ আর কাজের প্রয়োজনেই ইতিমধ্যে আটবার বাংলাদেশে পা রেখেছেন সুমাইয়া। সর্বশেষ এসেছেন বছর দুয়েক আগে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।
‘আগামী দু-এক বছরের মধ্যে আবারও বাংলাদেশে আসব আমি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলব এ দেশের নারীদের সঙ্গে। তাদের আমার কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করতে চাই।’ বলেছেন সুমাইয়া কাজি ইউনাইটেড নিউজ টোয়েনটি ফোর ডট কমকে।
....জানলেন তো সুমাইয়া কাজিকে। এবার গলা ফাটিয়ে বলুন ‘শাবাশ বাংলাদেশ!’ prothom-alo

Friday, March 9, 2012

তুষ হারিকেন পদ্ধতির জয়

তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে সদ্য ফোটানো হাঁসের বাচ্চা হাতে তাড়াইলের দামিহা গ্রামের আবুল হোসেন তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে সদ্য ফোটানো হাঁসের বাচ্চা হাতে তাড়াইলের দামিহা গ্রামের আবুল হোসেন
ছবি: প্রথম আলো
কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার দামিহা গ্রামে হাঁসের ডিম ফোটাতে প্রায় এক যুগ ধরে ব্যবহূত হচ্ছে ‘তুষ-হারিকেন পদ্ধতি’। এই গ্রামেরই এক ব্যক্তি এই পদ্ধতি ব্যবহারের সূচনা করেন। তাঁর নাম মো. আবুল হোসেন।
পদ্ধতিটি শুধু দামিহা গ্রামে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে পাশের রাহেলা ও কাচিলাহাটি গ্রামে। এই তিন গ্রামের ৩০টি হ্যাচারিতে প্রতি মৌসুমে প্রায় এক কোটি হাঁসের ছানা উৎপাদিত হচ্ছে।
তুষ-হারিকেন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এতে খরচ বেশ কম হয়। তাড়াইলে তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ছানা ফোটানোকে ‘বিপ্লব’ আখ্যায়িত করে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ছাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাকরি করেছি। আমার জানামতে, তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে এত বিপুলসংখ্যক হাঁসের বাচ্চা আর কোথাও ফোটানো হচ্ছে না।’
যেভাবে শুরু: দারিদ্র্যের কারণে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই স্কুল ছাড়তে হয় আবুল হোসেনকে। যোগ দেন কৃষিকাজে। কিন্তু চাষবাস তাঁর ভালো লাগত না। চেয়েছিলেন নতুন কিছু করতে। এক পরিচিতজনের মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে ভর্তি হন ঢাকার সাভার যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেটা ১৯৯১ সাল। সেখানে তিনি তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম ফোটানোর ওপর মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নেন।
এরপর ১৯৯৪ সালে কিশোরগঞ্জে সরকারি হাঁস-মুরগির খামারে আরও এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে দামিহা বাজারে শুরু করেন ওই পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম ফোটানোর কাজ। প্রথমদিকে মুনাফা কম হলেও হাল ছাড়েননি। প্রায় দুই বছর পর প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি আয়ত্ত করেন। এরপর সাফল্যের দেখা পান। বিষয়টি অজানা থাকে না প্রতিবেশীদের। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রচলিত পদ্ধতি ছেড়ে নতুন পদ্ধতিতে হাঁসের ছানা উৎপাদনের কাজ শুরু করেন একই গ্রামের নূরুল গনি, আবদুল গনি ও সোহাগ মিয়া।
উৎপাদন-পদ্ধতি: ডিম ফোটানোর জন্য ব্যবহূত হয় স্থানীয়ভাবে ‘সিলিন্ডার’ নামে পরিচিত বিশেষ পাত্র, ডিম রাখার মাচা এবং উৎপাদিত হাঁসের ছানা রাখার জায়গা। কাঠ, বাঁশ ও টিন দিয়ে ওই বিশেষ পাত্র ও মাচা তৈরি করা হয়। এ ছাড়া প্রয়োজন হয় তুষ, হারিকেন, লেপ, রঙিন কাপড়সহ আনুষঙ্গিক কিছু উপকরণ। ডিম সংগ্রহের পর জীবাণুনাশক দিয়ে সেগুলো ধুয়ে বাছাই করে রোদে শুকানো হয়। এরপর ডিমগুলো রঙিন কাপড়ের থলেতে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভরে সিলিন্ডারের ভেতরে রাখতে হয়। এক সিলিন্ডারে ডিম ও অন্য সিলিন্ডারে হারিকেন রেখে প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর তাপ এবং তাপবিহীন অবস্থায় লেপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়া ১৭ দিন ধরে চলে। এরপর ডিমগুলো মাচার ওপর সাজিয়ে হালকা কাপড়ে ঢেকে ১১ দিন রাখা হয়। ১২ দিনের মাথায় একের পর এক ডিম ফুটে হাঁসের ছানা বেরোতে থাকে। এভাবে ডিম ফোটাতে ২৮ দিন লাগে।
দামিহাসহ তিন গ্রামে তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর মোট ৩০টি হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। প্রতিটি হ্যাচারিতে এই পদ্ধতিতে প্রতি মাসে পর্যায়ক্রমে চারবার ডিম ফোটানো যায়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত প্রায় সোয়া দুই মাস ছানা উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ ছাড়া বছরের বাকি সময় ডিম ফোটানোর কাজ অব্যাহত থাকে এখানে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাস ডিম ফোটানোর জন্য উৎকৃষ্ট সময়। ৩০টি হ্যাচারি থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে সোয়া দুই লাখ বাচ্চা উৎপাদন করা হয়।
বাচ্চা ফোটানোর জন্য হাঁসের ডিম সংগ্রহ করা হয় খালিয়াজুরি, ইটনা, মিঠামইন, মদন, করিমগঞ্জ উপজেলাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এ জন্য ডিম উৎপাদনকারী খামারিদের অগ্রিম দাদন দিয়ে চুক্তি করে নিতে হয়।
খরচ ও লাভ: এই প্রক্রিয়ায় প্রতি ১০০ ছানা উৎপাদনে এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। প্রতি ১০০ ছানা বিক্রি হয় এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায়। এভাবে প্রতিটি বাচ্চা উৎপাদনে গড়ে লাভ হয় তিন-চার টাকা। সময়ভেদে এ লাভের পরিমাণ কমবেশি হয়।
এক দিন বয়সী হাঁসের ছানাগুলো পাইকারেরা কিনে নেন। এরপর সেগুলো সিলেট, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয়।
তাপমাত্রার ওঠানামা হলে মাঝেমধ্যে সব ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই ঝুঁকি এড়াতে সব সময় সতর্ক থাকতে হয় হ্যাচারির শ্রমিকদের।
স্থানীয়দের কথা: তুষ-হারিকেন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন দামিহা গ্রামের সোহাগ মিয়া, রাহেলা গ্রামের নজরুল ইসলাম, একই গ্রামের অসিম মিয়া ও কাছিলাহাটি গ্রামের কাজল মিয়া। এলাকায় এই পদ্ধতির প্রচলন করায় তাঁরা আবুল হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
দামিহা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত দুই শিক্ষক হিতাংশু চৌধুরী ও মো. আবুল হাসেম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর ফলে এলাকার পরিচিতি যেমন বেড়েছে, বিপুল মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে। তাঁরা বলেন, তুষ-হারিকেন পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে দামিহা এলাকায় কোনো হ্যাচারিশিল্প ছিল না। বর্তমানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগই আগে বেকার ছিলেন।
একই গ্রামের বাসিন্দা ভাস্কর্যশিল্পী সুষেন আচার্য বলেন, তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ছানা উৎপাদন একটি শিল্প। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা দেওয়া হলে ক্ষুদ্র এই শিল্পের পরিসর আরও বাড়বে।
সুদৃষ্টি কামনা: স্থানীয় হ্যাচারিগুলোর প্রতি প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি ঋণসুবিধা না থাকায় তাঁরা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ঋণ নিয়ে হ্যাচারি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। এরই মধ্যে ২০১০ সালে গঠিত হয়েছে ‘দামিহা ইউনিয়ন হ্যাচারি মালিক সমিতি’। আবুল হোসেন এই সমিতির সভাপতি। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে আবুল হোসেন বললেন, সহজ শর্তে স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হলে এ শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। আর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ছাইফুল ইসলাম বললেন, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে এখানকার হ্যাচারিশিল্প আরও সমৃদ্ধ হয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।

আশিতেও দীপ্ত আত্মানুসন্ধান

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আপন শিল্পকর্মের পাশে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আপন শিল্পকর্মের পাশে
ছবি: প্রথম আলো
আজ ৮০ বছর পূর্ণ হচ্ছে তাঁর। তবে ‘আসি’ বলে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন না। বরং ৮০-তেও নানান রঙের বিভায় উদ্ভাসিত তাঁর অন্তর। সৃজনশীলতা ও কর্মোদ্দীপনায় এখনো তারুণ্যের দীপ্তি। মনেই হয় না, ৮০ বছর হয়ে গেল দেশের বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর।
শিল্পী নিজেও গতকাল বৃহস্পতিবার সে কথাই বলছিলেন, ‘বেঁচে থাকলে স্বাভাবিক নিয়মেই বয়স হবে। ৮০ হলো। হয়তো ৮৫ হবে, ৯০ও হতে পারে। তবে বয়স যা-ই হোক, যত দিন বাঁচি, কাজ করে যেতে চাই। জীবনের কাছে এটাই প্রত্যাশা।’
সেই কাজ নিয়েই শিল্পীর জন্মদিনের উৎসব হবে আজ। তাঁর ৮০টি সাম্প্রতিক কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনীর নাম ‘আত্মানুসন্ধান’।
দীর্ঘ ৬০ বছরের শিল্পচর্চায় কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের চারুকলার ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন নিরলস সৃজনশীল কর্মপ্রবাহে। বিচিত্র তাঁর কাজের সম্ভার। সুকুমার শিল্পকলার সঙ্গে আছে ব্যবহারিক শিল্পকর্ম। চিত্রকলায় বাংলার নিসর্গ, ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির উপকরণ তাঁর নিজস্ব নান্দনিক বোধে জারিত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে আধুনিক আঙ্গিকে। বিদগ্ধজনেরা অনেকে বলেছেন, কবিতায় যেমন জীবনানন্দ দাশ বাংলার নিসর্গ ও ঐতিহ্যকে আধুনিক কলাকৃতির অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করেছিলেন, শিল্পকলার ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরীও সেই কাজটিই করেছেন। অধিকন্তু তিনি তাঁর কর্মপ্রবাহকে ব্যবহারিক শিল্পকলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করে এই জনপদে শিল্পরুচি সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বইয়ের প্রচ্ছদ, বিজ্ঞাপন, নানা প্রতিষ্ঠানের লোগো এবং বিশেষত বাংলা অক্ষরকে তিনি এক অনন্য সুষমায় উপস্থাপন করেছেন।
কাইয়ুম চৌধুরী এই ছয় দশকের শিল্পসাধনায় নিজের কাজকে নিরন্তর নিরীক্ষা ও নতুনত্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘আমি কখনোই একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাইনি। সংস্কৃতির উপাদান, প্রকৃতির সৌন্দর্য, আমার ভাবনা—এসব সংমিশ্রণ করে নানা আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছি। জীবনের যা কিছু ভালো ও সুন্দর, যা দেখে বাঁচতে ইচ্ছে করে, তাকেই আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি। যেন আমার ছবি যাঁরা দেখবেন, তাঁরাও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত বোধ করেন।’
সেই সুন্দর ভুবনের দ্বার উন্মোচিত হবে আজ শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টায়। ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারিতে ‘আত্মানুসন্ধান’ নামের এই প্রদর্শনীর দ্বারোদ্ঘাটন করবেন শিল্পীর বন্ধু শিল্পী মুর্তজা বশীর, লেখক সৈয়দ শামসুল হক, শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। শিল্পীর স্বজন, সুহূদ, অনুরাগীরা তাঁকে জন্মদিনের প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাবেন।
‘আত্মানুসন্ধান’ প্রদর্শনী চলবে ২২ মার্চ অবধি। খোলা থাকবে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।
এবারের প্রদর্শনীতে দর্শকেরা নতুন আঙ্গিকে পাবেন তাঁদের প্রিয় শিল্পীকে। অ্যাক্রিলিক, ছাপচিত্র, প্যাস্টেল, মিশ্রমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ রয়েছে এতে। চিত্রপটে অনেক স্পেস ছেড়ে কাজ করেছেন, আকার-আকৃতির বিন্যাসেও আছে নিরীক্ষা। পাখি, নৌকা, মাছ, ফুল-পাতায় ভরা শাখা, নদীর রেখা, তার সঙ্গে মানব-মানবীর আদল, জ্যামিতিক ও লোকজ অঙ্কনরীতির নকশা—এসবের মধ্য দিয়েই অতিচেনা কাইয়ুম চৌধুরীকে পাওয়া যাবে নবব্যঞ্জনায়। সেই সঙ্গে মাঠের সবুজ, আকাশের নীল, শিমুল-পলাশের রক্তিম উচ্ছ্বাস, সূর্যের দীপ্তি, হাওয়ার চঞ্চলতা, নদীস্রোতের গতিধারা তিনি রেখায়-আঁচড়ে, তুলির টানে মিলিয়ে দিয়েছেন চিরন্তন মানবিক অনুভূতির সঙ্গে। এর মধ্য দিয়েই অনুসন্ধান করেছেন মানবমুক্তির সংগ্রাম, সমাজ-প্রগতির স্বরূপ।
প্রদর্শনী উপলক্ষে গতকাল দুপুরে বেঙ্গল গ্যালারিতে সংবাদ সম্মেলন ও প্রেস প্রিভিউয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে শিল্পীর কাজ নিয়ে তাঁর ছাত্র ও সহকর্মী শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, ‘এই বয়সেও তিনি যেমন সতেজ, উদ্দীপনাময় এবং সৃজনশীল রয়েছেন, তা তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। এমন এক স্বকীয়তা তিনি অর্জন করেছেন, যে মাধ্যমেই কাজ করেন, যত নিরীক্ষাই করেন, কাজ দেখেই তাঁকে চেনা যায়। যেমন: পিকাসো নানা মাধ্যমে, নানা ধরনের কাজ করলেও কাজ দেখেই তাঁকে চেনা যায়। এই স্বকীয়তা অর্জন করা বড় মাপের শিল্পীর বৈশিষ্ট্য। কাইয়ুম চৌধুরী তা অর্জন করেছেন।’
প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে নেপথ্যচারী মানুষ। তা সত্ত্বেও তিনি ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর শিল্পীচেতনার ছাপ রেখে গেছেন। পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট, পুস্তিকার অলংকরণসহ বৈচিত্র্যময় তাঁর কাজ। এই বহুমাত্রিক শিল্পচর্চার ভেতর দিয়ে তিনি জাতির অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করেছেন। তাঁর জন্মদিনের এই প্রদর্শনীটি এ কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল মনসুর বলেন, ‘আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বাধিকারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে শিল্পের যোগসূত্র সৃষ্টি, বিশেষত মুদ্রণশিল্পের আধুনিকায়নে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন। এই বয়সেও যেভাবে তিনি সৃজনশীল রয়েছেন, তা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত।’ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক সারোয়ার জাহান; সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক সুবীর চৌধুরী।
আর শিল্পীর কী অনুভূতি? গ্যালারির চার দেয়ালে আপন সৃজনসম্ভার। রঙে-রেখায়, আকৃতি-অবয়বে, স্বদেশ-স্বজাতির অন্তরাত্মার উদ্ভাসন। সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা করেছি, প্রাপ্তি তার থেকে অনেক বেশি। এই প্রাপ্তি মানুষের ভালোবাসা। যাবার বেলায় এটা নিয়েই যেতে চাই।’
এই তো, এর চেয়ে আর কী লাগে মানুষের! এ প্রত্যাশা পূরণ হোক—জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘ পরমায়ু কামনার সঙ্গে এই প্রার্থনাই থাকবে প্রিয় শিল্পীর জন্য। prothom-alo

Friday, January 27, 2012

একজন ময়েন স্যার

গোপালগঞ্জ শহরের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ছেন সদস্যরা। বসে আছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মঈন উদ�গোপালগঞ্জ শহরের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ছেন সদস্যরা। বসে আছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মঈন উদ্দিন (ডানে)
ছবি: প্রথম আলো
বই মানুষকে আলোকিত করে। পাঠাগারকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ে জ্ঞানের সেই আলো। এমনই এক পাঠাগার প্রায় ছয় দশক ধরে আগলে রেখেছেন গোপালগঞ্জের ‘ময়েন স্যার’। অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক হিসেবে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজ করছেন অক্লান্তভাবে।
অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষকের পুরো নাম মঈন উদ্দিন। শহরের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সেই ১৯৫৬ সাল থেকে। তাঁর হাত ধরেই বেড়েছে এই পাঠাগারের কলেবর। শহরে গড়ে উঠেছে একটি পাঠক সমাজ। আলোর পরশ পেয়েছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সবার চোখেই নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি আর ‘ময়েন স্যার’ অভিন্ন সত্তা। গোপালগঞ্জের এস এম মডেল স্কুল থেকে ১৯৯০ সালে অবসর নেন মঈন উদ্দিন। কিন্তু পাঠাগারের প্রতি দায়িত্ব শেষ করেননি এই ৭৮ বছর বয়সেও।
দিনলিপি: প্রতিদিন সকালে পাঠাগারের তালা খোলেন মঈন উদ্দিন। সদস্যদের বই দেওয়া থেকে শুরু করে পাঠাগার ঝাড়ু দেওয়ার কাজও করেন। এই পাঠাগারকে ধ্যানজ্ঞান করেই তরুণ বয়স থেকে শুরু করে জীবনের অধিকাংশ সময় পার হয়ে গেছে তাঁর। পরিবারের চেয়েও বেশি সময় তিনি দিয়েছেন এই পাঠাগারে। বই পড়ার অভ্যাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান তিনি। পাঠাগারটি বর্তমানে পরিণত হয়েছে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে।
পাঠাগারে যত বই: নজরুল পাবলিক লাইব্রেরিতে রয়েছে ১৩ হাজার ৯০০ বই ও সাময়িকী। ধ্রুপদি সাহিত্যের বইয়ের মধ্যে রয়েছে হোমারের ইলিয়াড, ওডিসি এবং দান্তে রচনাবলির বাংলা অনুবাদ। আছে পারস্যের কবি ফেরদৌসি রচিত শাহনামা। আছে প্রতীচ্য পুরাণ, রবীন্দ্র রচনাবলি ও নজরুল রচনাবলি। পুরোনো বইয়ের মধ্যে আছে ১৯৫৮ সালের সংস্করণসহ স্ট্যান্ডার্ড জেনারেল নলেজ-এর বিভিন্ন সংস্করণ। রয়েছে রবীন্দ্র রচনাবলির ইংরেজি সংকলন দি গোল্ডেন বুক অব টেগোর (১৯৩১), ফান্ডামেন্টাল রুলস অ্যান্ড সিভিল সার্ভিস রেগুলেশন (১৯৫৭) ও কাজী মোতাহার হোসেনের গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস। পুরোনো সাময়িকীর মধ্যে রয়েছে দি মডার্ন রিভিউ (১৯৩৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত), বিচিত্রা, ভারতবর্ষ, দেশসহ সাপ্তাহিক ও মাসিক বিভিন্ন পত্রিকার ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সংখ্যার বাঁধাই সংস্করণ।
যেভাবে হলো: নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির আদি নাম ছিল করোনেশন লাইব্রেরি। ১৯২০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে ভারতজুড়ে উৎসব উদ্যাপনের আয়োজন করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। এ জন্য ভারতের সব জেলা এমনকি মহকুমা শহরে অর্থ পাঠানো হয়। গোপালগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তখন স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করেন। নাট্যামোদী ১২ সদস্যের আগ্রহে সিদ্ধান্ত হয় একটি থিয়েটার ক্লাব গড়ে তোলার। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় করোনেশন থিয়েটার ক্লাব। সেখানে শহরের সুশীল সমাজের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ একটি পাঠাগার স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ক্লাব পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় করোনেশন পাবলিক লাইব্রেরি। শুরু থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাঠাগারটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন প্রতাপ বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি। এরপর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।
মঈন উদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণ: মা-বাবার অসুস্থতার কারণে সে সময় কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন মঈন উদ্দিন। বই পড়া ও সংগ্রহে অসীম আগ্রহ দেখে তাঁকে সবাই পাঠাগারের দায়িত্ব নিতে বলেন। এভাবেই করোনেশন থিয়েটার ক্লাব ও পাঠাগারের সঙ্গে জড়িয়ে যান মঈন উদ্দিন। সেই থিয়েটার ক্লাবে তখন টিকিটের বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী হতো। এই ক্লাবকে কেন্দ্র করে তখন শহরে গড়ে উঠেছিল ১৮টি ড্রামা ক্লাব ও অনেক পাঠাগার।
পাঠাগারের জন্য ত্যাগ: কলকাতা থেকে এসেছিল বাহারি চাকরির আহ্বান। ‘দ্য ক্যাভেন্ডার্স’ নামে একটি ব্রিটিশ বিপণন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সচ্ছল ভবিষ্যৎ ও বিলাসী জীবনের হাতছানি। কিন্তু পাঠাগারের জন্য তত দিনে বিশেষ মায়া জন্মে গেছে মনে। তাই কলকাতার ডাক উপেক্ষা করলেন মঈন উদ্দিন। কিন্তু জীবন-বাস্তবতা তাঁকে ঠেলে দেয় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তখন এগিয়ে আসেন। মঈন উদ্দিনের চাকরির ব্যবস্থা করেন এসএম মডেল স্কুলে। মাত্র ১০০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। বাকি সময় কাটান পাঠাগারে।
নতুন নামকরণ: পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগ। শহরে তখন মুসলিম লীগ নেতাদের দাপট। তাঁরা করোনেশন পাবলিক লাইব্রেরির নাম বদলে পাকিস্তানের বিশিষ্ট কবি ইকবালের নামে নামকরণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হতে দেননি মঈন উদ্দিন। তিনি বাংলা ভাষার কোনো কবির নামে পাঠাগারের নামকরণের দাবি তোলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করা হয়। ছাত্র-জনতার দাবির মুখে পাঠাগারের নতুন নাম হয় নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি।
পাঠাগারের টিকে থাকা: পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে এক ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় করোনেশন থিয়েটার ক্লাব ও পাঠাগার। তখন পাঠাগারটি তাৎক্ষণিকভাবে স্থানান্তর করা হয় মডেল স্কুল সড়কের একটি টিনের ঘরে। এটি ছিল মঈন উদ্দিনের তৎকালীন বাসস্থানের একটি অংশ। বই ও আসবাবের স্থান সংকুলানের অভাবে পাঠাগারটি সরানো হয় ভাষাসৈনিক পরেশ বিশ্বাসের মধ্যপাড়ার বাড়িতে। কয়েক বছর এভাবেই চলে পাঠাগারের কার্যক্রম। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? স্বপ্নের পাঠাগারের স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন মঈন উদ্দিন। এ ব্যাপারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক শহীদ হামিদ খান। স্থায়ী পাঠাগার স্থাপনের জন্য মাত্র তিন দিনের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ জমির ব্যবস্থা করেন তিনি। মঈন উদ্দিনের সম্বল তখন মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা। ওই টাকায় তিনি একটি টিনের ঘর তৈরির পরিকল্পনা নেন। কিন্তু বাধা দেন মহকুমা প্রশাসক। তিনি সেখানে একতলা ভবন তৈরির পরিকল্পনা করেন। বাজেট ৬০ হাজার টাকা। মঈন উদ্দিনের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এত টাকা কোথায় পাবেন? তখন তাঁকে অভয় দেন হামিদ খান। সরকারি কোষাগার থেকে কিছু টাকার সংস্থান হয়। তৎকালীন ঠিকাদার ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাইদ আলী খানকে এই ভবন নির্মাণকাজের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন হামিদ খান। সাইদ আলী খান রাজি হয়ে যান। এভাবেই নির্মিত হয় নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির বর্তমান ভবন।
একজন ময়েন স্যার: গোপালগঞ্জের খ্যাতনামা এস এম মডেল স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন মঈন উদ্দিন। ফলে এলাকায় তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রচুর। সবার কাছেই তিনি ‘ময়েন স্যার’। আর পাঠাগারের প্রতি আজীবন শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে তিনি অর্জন করেছেন সবার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। ধৈর্যশীল, নীতিবান, অসাম্প্রদায়িক, সদালাপী ও স্বল্পভাষী এই মানুষটি বছরের পর বছর পড়াশোনা করেছেন বহুমুখী বিষয়ে। তাঁর সঙ্গে আলাপ করলেই সেটা বোঝা যায়। সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এই মানুষটি কথা বলেন প্রাণ খুলে। রিকশায় চড়ার বিলাসিতা তাঁর নেই। হেঁটেই চলাফেরা করেন এখনো।
শিক্ষক হিসেবেও ‘ময়েন স্যার’ অতুলনীয়। ছাত্রছাত্রীদের কখনো সাজেশন দেননি। কোনো দিন প্রাইভেট পড়াননি। কোনো দিন ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থ করার জন্য চাপ দেননি।
পরিবারের চোখে: স্ত্রীর নাম জাহান জেব বানু। স্বামীকে নিয়ে গর্বিত তিনি। তাঁদের চার ছেলের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বাবাকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই তাঁদের। শহরের মধ্যপাড়ার একটি বাড়িতে এই পরিবারটির বাস।
প্রত্যাশা: মঈন উদ্দিন এখন খুঁজে ফিরছেন এমন একজন মানুষকে, যিনি এই পাঠাগারটিকে মনে-প্রাণে ভালোবাসবেন। যাঁর হাত ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি সামনের দিকে এগোবে। সে রকম একজনের হাতেই তিনি তুলে দিতে চান পাঠাগারের দায়িত্ব। মঈন উদ্দিন বেঁচে থাকতে চান এই পাঠাগারের মধ্যে, মানুষের পাঠাভ্যাসের মধ্যে। prothom-alo

Friday, December 30, 2011

ধনেপাতায় ধনদৌলত

নিজের ধনেপাতা খেতে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ভেতরকুঠি গ্রামের তৈয়ব আলী
ছবি: প্রথম আলো
শীত মৌসুমে ধনেপাতার কদর বাঙালির ঘরে ঘরে। তরিতরকারিতে স্বাদ আনতে ধনেপাতার জুড়ি নেই। মচমচে মুড়ি, তেল-মরিচ-পেঁয়াজের সঙ্গে ধনেপাতা কুচি কুচি করে কেটে মেখে খেতে খুবই মজা। অনেকেই আছেন, পাতে একটু ধনেপাতার ভর্তা হলেই তাঁদের ভরপেট ভাত খাওয়া হয়ে যায়।
গ্রামবাংলার অনেক বাড়িতে ধনেপাতার চাষ করে মূলত পরিবারের চাহিদা মেটানো হয়। তবে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সাড়াই ইউনিয়নের ভেতরকুটি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় ধনেপাতার। ১৬ বছর আগে তৈয়ব আলীর (৬০) হাত ধরে সূচনা হয় এ চাষের। তাঁর সাফল্য দেখে গ্রামের অন্যরাও চাষে লেগে পড়েন। এখন গ্রামের মাঠের পর মাঠ ধনেপাতার চাষ হয়। যাঁদের জমি নেই, তাঁরা বর্গা নিয়ে চাষ করেন।
অথচ একসময় এ গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিলেন অভাবী। উঁচু এলাকা বলে ধানসহ অন্যান্য ফসল এখানে ভালো হতো না। খাবারও জুটত না অনেকের। তবে এখন দিন বদলেছে। ভেতরকুটির মানুষ ধনেপাতা চাষ করে ভালো করেছেন আর্থিক অবস্থা। এই গ্রামের সবাই বেশ সচ্ছল, সুখী জীবন।
এক দিন সেই গ্রামে: কাউনিয়া উপজেলার সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে ভেতরকুটি গ্রাম। লোকসংখ্যা হাজার দেড়েক।
কাঁচা-পাকা পথ ধরে গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মাঠজুড়ে অসংখ্য ধনেপাতার খেত। বেশির ভাগ বাড়িতে চকচক করছে টিনের চাল। আধাপাকা বাড়িও আছে কয়েকটি। কোথাও শণ বা খড়ের কুঁড়েঘর দেখা গেল না। তৈয়ব আলীর বাড়ি খোঁজ করতেই একজন দেখিয়ে দেন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, তৈয়ব ধনেপাতা তুলছেন, সঙ্গে পুত্রবধূরাও।
সংগ্রাম: ১৯৫১ সালে অভাবের সংসারে জন্ম তৈয়ব আলীর। লেখাপড়া করা হয়নি। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি বড়। ১০ বছর বয়সে মারা যান বাবা। ১১ বছর বয়সে হারান মাকে। ১৩ বছর বয়সে ধরেন সংসারের হাল।
বাড়িতে ধান সিদ্ধ করে চাল তৈরির পর তা বাজারে বেচার কাজ শুরু করেন তৈয়ব। কয়েক বছর চালের ব্যবসা করেন, কিন্তু অভাব পিছু ছাড়ে না। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে চালের ব্যবসা ছেড়ে দেন। কয়েক মাস বেকার ঘুরে বেড়ানোর পর গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের পরামর্শে শুরু করেন কাঁচা তরকারির ব্যবসা। ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে খেত থেকে করলা কিনতে পাশের নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী গ্রামে যান। সেখানে নাজমুল নামের একজনের কাছে ধনেপাতা চাষ করে ভাগ্য বদলানোর গল্প শোনেন। বিষয়টি তাঁর মনে ধরে। ঠিক করেন, ধনেপাতা চাষ করে অভাব জয় করবেন।
ওই বছরের নভেম্বরে ১০ শতক জমিতে তিনি ধনেপাতার চাষ করেন। ৩০ দিনে এ ধনেপাতা বেচে খরচ বাদে চার হাজার টাকা আয়ও হয়। পরের বছর ৪০ শতকে দুই দফায় ৭০ দিনে চাষ করে আয় করেন ৩০ হাজার টাকা। এরপর পুরোপুরি লেগে পড়েন। স্ত্রী-পুত্ররাও তৈয়ব আলীর সঙ্গে হাত লাগান। সংসারে আসে সচ্ছলতা।
ধনেপাতার চাষের টাকায় কেনেন তিন একর জমি, বানান পাকা বাড়ি। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তিন ছেলে ধনেপাতা আর নানা সবজি চাষে লেগে আছেন। এবার দেড় একর জমিতে ধনেপাতার চাষ করে এক লাখ টাকা আয় করেছেন।
ভাগ্য বদলাল যাঁরা: ভেতরকুটি গ্রামের আবুল কালাম সংসার চালাতে কখনো দিনমজুরি, কখনো বা রিকশা চালাতেন। এর পরও আট সদস্যের পরিবারে অভাব লেগে থাকত। তৈয়ব আলীর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি অন্যের ১৫ শতক জমি বর্গা নেন।
শুরু করেন ধনেপাতার চাষ। বদলে যায় ভাগ্যের চাকা। ধনেপাতা বেচার টাকায় কেনেন দেড় একর জমি। বানান পাকা বাড়ি। এবার ৮০ শতকে ধনেপাতার চাষ করে আয় করেছেন ৫২ হাজার টাকা।
গ্রামের মোসলেমার স্বামী ২০ শতক বসতভিটা আর দুই সন্তান রেখে ১২ বছর আগে মারা যান। অসহায় মোসলেমা শুরু করেন দিনমজুরি। এ কষ্ট দেখে তৈয়ব আলী পরামর্শ দেন ধনেপাতা চাষের। তৈয়বের কাছ থেকে বীজ নিয়ে মোসলেমা বসতভিটার চারদিকে ধনেপাতা চাষ করেন।
৩০ দিনের মধ্যে এ ধনেপাতা বেচে আয় হয় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। পরের বছর অন্যের ২০ শতক জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। এবার ৭০ শতক জমিতে এ ফসলের চাষ করেছেন। সন্তানদের নিয়ে বেশ ভালো আছেন।
গ্রামের আবদুল হালিম, ফিরোজা বেগম, মঞ্জিলা খাতুন, মোর্শেদা বেগম, সাহেদা খাতুন, জহরা বেগম, লাল মিয়াসহ অনেকেই ধনেপাতা চাষ করে ভাগ্য বদলের গল্প শোনালেন।
লাভ অনেক: গ্রামের কৃষক মোবারক হোসেন বলেন, ধনেপাতা চাষে পরিশ্রম কম। চারবার লাঙলের হাল দিয়ে চাষ করে একরে ৭০ কেজি ধনেপাতার বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। বীজ বপনের ২০ দিনের মাথায় হালকা একটা সেচ দিতে হয়। সার, কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। লাগে না তেমন পরিচর্যাও। ৩০ দিন পর খেত থেকে ধনেপাতা তুলে ওই জমিতে আবারও ধনেপাতা চাষ করা যায়।
কাউনিয়া উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুভলচন্দ্র বর্মণ বলেন, ধনেপাতার চাষ খুবই লাভজনক। এক একর জমিতে ধনেপাতা চাষ করতে বীজ-গোবর-চাষাবাদ বাবদ নয় থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। শুরুতে ১০০ টাকা এবং শেষে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও একরপ্রতি ৬০ হাজার টাকা আয় হয়, যা অন্য কোনো ফসল থেকে এত কম সময়ে আয় করা যায় না।
ধূমেরকুটি গ্রামের ধনেপাতার পাইকারি ব্যবসায়ী লাল মিয়া ও আবু বকর জানান, তাঁরা খেত থেকে ধনেপাতা কেনেন। এরপর হকের বাজার, মায়ার বাজার, খানসামা বাজার, কাউনিয়া বাজার, মেরাজের বাজারে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।
অন্যদের কথা: সাড়াই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, এক যুগ আগেও ভেতরকুটি গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। উঁচু এ এলাকায় ফসলাদি ভালো হতো না। এখন ধনেপাতাসহ নানান সবজি চাষ করে গ্রামবাসী অভাবকে জয় করেছেন। এ গ্রামের মানুষের সাফল্য দেখে পাশের বাইরাকুটি, সোনাতলা, কদমতলা, বালাপাড়া, বিশ্বনাথ চরে কৃষকেরা এসব ফসলের চাষ করছেন।
কাউনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, ভেতরকুটি গ্রামে ১৪-১৫ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে ধনেপাতার চাষ হচ্ছে। গ্রামের অন্তত ৭০ শতাংশ লোক এ চাষের সঙ্গে জড়িত। পুরো উপজেলায় প্রায় ৭২০ একর জমিতে ধনেপাতার চাষ হয়। prothom-alo

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons