Total Pageviews

Friday, March 9, 2012

তুষ হারিকেন পদ্ধতির জয়

তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে সদ্য ফোটানো হাঁসের বাচ্চা হাতে তাড়াইলের দামিহা গ্রামের আবুল হোসেন তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে সদ্য ফোটানো হাঁসের বাচ্চা হাতে তাড়াইলের দামিহা গ্রামের আবুল হোসেন
ছবি: প্রথম আলো
কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার দামিহা গ্রামে হাঁসের ডিম ফোটাতে প্রায় এক যুগ ধরে ব্যবহূত হচ্ছে ‘তুষ-হারিকেন পদ্ধতি’। এই গ্রামেরই এক ব্যক্তি এই পদ্ধতি ব্যবহারের সূচনা করেন। তাঁর নাম মো. আবুল হোসেন।
পদ্ধতিটি শুধু দামিহা গ্রামে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে পাশের রাহেলা ও কাচিলাহাটি গ্রামে। এই তিন গ্রামের ৩০টি হ্যাচারিতে প্রতি মৌসুমে প্রায় এক কোটি হাঁসের ছানা উৎপাদিত হচ্ছে।
তুষ-হারিকেন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এতে খরচ বেশ কম হয়। তাড়াইলে তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ছানা ফোটানোকে ‘বিপ্লব’ আখ্যায়িত করে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ছাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাকরি করেছি। আমার জানামতে, তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে এত বিপুলসংখ্যক হাঁসের বাচ্চা আর কোথাও ফোটানো হচ্ছে না।’
যেভাবে শুরু: দারিদ্র্যের কারণে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই স্কুল ছাড়তে হয় আবুল হোসেনকে। যোগ দেন কৃষিকাজে। কিন্তু চাষবাস তাঁর ভালো লাগত না। চেয়েছিলেন নতুন কিছু করতে। এক পরিচিতজনের মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে ভর্তি হন ঢাকার সাভার যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেটা ১৯৯১ সাল। সেখানে তিনি তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম ফোটানোর ওপর মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নেন।
এরপর ১৯৯৪ সালে কিশোরগঞ্জে সরকারি হাঁস-মুরগির খামারে আরও এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে দামিহা বাজারে শুরু করেন ওই পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম ফোটানোর কাজ। প্রথমদিকে মুনাফা কম হলেও হাল ছাড়েননি। প্রায় দুই বছর পর প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি আয়ত্ত করেন। এরপর সাফল্যের দেখা পান। বিষয়টি অজানা থাকে না প্রতিবেশীদের। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রচলিত পদ্ধতি ছেড়ে নতুন পদ্ধতিতে হাঁসের ছানা উৎপাদনের কাজ শুরু করেন একই গ্রামের নূরুল গনি, আবদুল গনি ও সোহাগ মিয়া।
উৎপাদন-পদ্ধতি: ডিম ফোটানোর জন্য ব্যবহূত হয় স্থানীয়ভাবে ‘সিলিন্ডার’ নামে পরিচিত বিশেষ পাত্র, ডিম রাখার মাচা এবং উৎপাদিত হাঁসের ছানা রাখার জায়গা। কাঠ, বাঁশ ও টিন দিয়ে ওই বিশেষ পাত্র ও মাচা তৈরি করা হয়। এ ছাড়া প্রয়োজন হয় তুষ, হারিকেন, লেপ, রঙিন কাপড়সহ আনুষঙ্গিক কিছু উপকরণ। ডিম সংগ্রহের পর জীবাণুনাশক দিয়ে সেগুলো ধুয়ে বাছাই করে রোদে শুকানো হয়। এরপর ডিমগুলো রঙিন কাপড়ের থলেতে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভরে সিলিন্ডারের ভেতরে রাখতে হয়। এক সিলিন্ডারে ডিম ও অন্য সিলিন্ডারে হারিকেন রেখে প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর তাপ এবং তাপবিহীন অবস্থায় লেপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়া ১৭ দিন ধরে চলে। এরপর ডিমগুলো মাচার ওপর সাজিয়ে হালকা কাপড়ে ঢেকে ১১ দিন রাখা হয়। ১২ দিনের মাথায় একের পর এক ডিম ফুটে হাঁসের ছানা বেরোতে থাকে। এভাবে ডিম ফোটাতে ২৮ দিন লাগে।
দামিহাসহ তিন গ্রামে তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর মোট ৩০টি হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। প্রতিটি হ্যাচারিতে এই পদ্ধতিতে প্রতি মাসে পর্যায়ক্রমে চারবার ডিম ফোটানো যায়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত প্রায় সোয়া দুই মাস ছানা উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ ছাড়া বছরের বাকি সময় ডিম ফোটানোর কাজ অব্যাহত থাকে এখানে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাস ডিম ফোটানোর জন্য উৎকৃষ্ট সময়। ৩০টি হ্যাচারি থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে সোয়া দুই লাখ বাচ্চা উৎপাদন করা হয়।
বাচ্চা ফোটানোর জন্য হাঁসের ডিম সংগ্রহ করা হয় খালিয়াজুরি, ইটনা, মিঠামইন, মদন, করিমগঞ্জ উপজেলাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এ জন্য ডিম উৎপাদনকারী খামারিদের অগ্রিম দাদন দিয়ে চুক্তি করে নিতে হয়।
খরচ ও লাভ: এই প্রক্রিয়ায় প্রতি ১০০ ছানা উৎপাদনে এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। প্রতি ১০০ ছানা বিক্রি হয় এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায়। এভাবে প্রতিটি বাচ্চা উৎপাদনে গড়ে লাভ হয় তিন-চার টাকা। সময়ভেদে এ লাভের পরিমাণ কমবেশি হয়।
এক দিন বয়সী হাঁসের ছানাগুলো পাইকারেরা কিনে নেন। এরপর সেগুলো সিলেট, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয়।
তাপমাত্রার ওঠানামা হলে মাঝেমধ্যে সব ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই ঝুঁকি এড়াতে সব সময় সতর্ক থাকতে হয় হ্যাচারির শ্রমিকদের।
স্থানীয়দের কথা: তুষ-হারিকেন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন দামিহা গ্রামের সোহাগ মিয়া, রাহেলা গ্রামের নজরুল ইসলাম, একই গ্রামের অসিম মিয়া ও কাছিলাহাটি গ্রামের কাজল মিয়া। এলাকায় এই পদ্ধতির প্রচলন করায় তাঁরা আবুল হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
দামিহা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত দুই শিক্ষক হিতাংশু চৌধুরী ও মো. আবুল হাসেম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর ফলে এলাকার পরিচিতি যেমন বেড়েছে, বিপুল মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে। তাঁরা বলেন, তুষ-হারিকেন পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে দামিহা এলাকায় কোনো হ্যাচারিশিল্প ছিল না। বর্তমানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগই আগে বেকার ছিলেন।
একই গ্রামের বাসিন্দা ভাস্কর্যশিল্পী সুষেন আচার্য বলেন, তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ছানা উৎপাদন একটি শিল্প। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা দেওয়া হলে ক্ষুদ্র এই শিল্পের পরিসর আরও বাড়বে।
সুদৃষ্টি কামনা: স্থানীয় হ্যাচারিগুলোর প্রতি প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি ঋণসুবিধা না থাকায় তাঁরা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ঋণ নিয়ে হ্যাচারি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। এরই মধ্যে ২০১০ সালে গঠিত হয়েছে ‘দামিহা ইউনিয়ন হ্যাচারি মালিক সমিতি’। আবুল হোসেন এই সমিতির সভাপতি। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে আবুল হোসেন বললেন, সহজ শর্তে স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হলে এ শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। আর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ছাইফুল ইসলাম বললেন, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে এখানকার হ্যাচারিশিল্প আরও সমৃদ্ধ হয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons