জীবনে সাফল্যের নানা মাপকাঠি: যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি, আরও কত কী। সাফল্যের সূচক যা-ই হোক না কেন, সফল ব্যক্তির সঙ্গে অসফলের একটা তফাত চোখে পড়ে। অসফল মানুষ সচরাচর পারিপার্শ্বিক বা বাতাবরণকে দোষারোপ করে থাকেন। বাবা-মা যদি একটা ভাল স্কুলে পাঠাতেন! বাবা-মায়ের যদি প্রচুর টাকাপয়সা থাকত, যদি বিদেশে পাঠিয়ে দিতেন পড়তে! যদি আমেরিকায় জন্মাতাম! পারিপার্শ্বিককে যখন বদলানো যাবে না, তখন তাকে দোষ দিয়ে লাভ কী? খুব কম সফল ব্যক্তিকেই বাতাবরণকে দোষ দিতে দেখেছি। বরং পারিপার্শ্বিককে স্বীকার করেই তাঁরা এগিয়ে চলেন। পারিপার্শ্বিকটা আসলে ইতিহাস বা অতীতের মতো। অতীতের একটি প্রতিশব্দ ভূত। সাফল্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ভূতে আটকা পড়ে থাকলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎও হাত থেকে ফসকে যাবে।
পারিপার্শ্বিককে যাঁরা দোষ দেন না, তাঁদের মধ্যেও কিন্তু অন্য একটা প্রবণতা দেখা যায়। তাঁরা নিজেরাই ঠিক করে উঠতে পারেন না, তাঁদের ‘অবজেকটিভ ফাংশন’টা ঠিক কী, অর্থাৎ তাঁরা জীবনে ঠিক কী পেতে চান, সাফল্য বলতে ঠিক কী বোঝেন। অধিকাংশ সফল ব্যক্তি নিজেদের অবজেক্টিভ ফাংশন সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন। অবজেক্টিভ ফাংশনটা বদলায়ও না, তাই পরবর্তী কালে অনুতাপের অবকাশ নেই। অন্য ভাষায় বললে, তাঁদের জীবনে ফোকাস আছে। অর্জুনের পাখির চোখ দেখার মতো। অন্যদের ফোকাস ছিল না বলেই তারা অর্জুন হয়ে উঠতে পারেনি। সফল ব্যক্তিদের মধ্যেই আর একটি গুণ লক্ষ করেছি। তাঁরা একই সঙ্গে দশটা আলাদা আলাদা কাজ করে চলেন। দশটা কাজ একসঙ্গে কী করে করা যায়? মন তো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে! একটা কাজ করার সময় তো অন্য কাজটার কথা মাথায় ঘুরতে থাকে! এই সব সফল ব্যক্তিকে ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয়েছে, তাঁরা একসঙ্গে দশটা কাজ করেন— এই ধারণাটা ভুল। এক সময়ে তাঁরা একটাই কাজ করেন, এবং সেই সময়টার জন্য অন্য সব কাজের কথা ভুলে যান। পরমুহূর্তেই, এই কাজটা শেষ হয়ে গেলে, মন চলে যায় অন্য কাজে। অর্থাৎ, সকাল ন’টায় যা করছি, সকাল দশটায় হয়তো তা করছি না। কিন্তু দশটার সময় যে কাজ করব তার কথা ন’টায় ভুলে থাকছি এবং ন’টার সময় যে কাজ করলাম সেটা দশটায় ভুলে যাচ্ছি। এই কমপার্টমেন্টালাইজ করা, মানে মগজটার মধ্যে কাজের চিন্তাগুলোকে আলাদা আলাদা খোপে ভাগ করে রাখার ক্ষমতাটা অত্যন্ত দুর্লভ। মহাভারতে বলা সেই লক্ষ্যভেদের পরে অর্জুন কী করেছিলেন? হয়তো ভাইদের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিলেন পাখির কথা। অর্জুনের আর এক নাম গূঢ়াকেশ। গূঢ়াকেশ মানে যিনি নিদ্রাকে জয় করেছেন। দ্রোণাচার্য দেখলেন, গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমোচ্ছে, তখন অর্জুন ধনুর্বিদ্যা চর্চায় রত। এ ভাবেই তিনি হয়ে উঠলেন দ্রোণাচার্যের প্রিয় শিষ্য। হঠাৎ গভীর রাতে অর্জুন কেন ধনুর্বিদ্যা চর্চা করছিলেন, মহাভারতে সে কথা খুব স্পষ্ট ভাবে বলা নেই। হয়তো না দেখে শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপের দক্ষতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তিনি, অথবা হয়তো দিনের বেলায় ধনুর্বিদ্যা অভ্যাসের জন্য যথেষ্ট সময় ছিল না। কারণটা যা-ই হোক, এ ভাবে নিদ্রাকে জয় করে অর্জুন হলেন গূঢ়াকেশ। এই গল্পটার মধ্যে হয়তো সাফল্যের আর একটা মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে। যার অবজেক্টিভ ফাংশন সুস্পষ্ট, সে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। বাড়িতে আলো নেই বলে বিদ্যাসাগর রাস্তার আলোয় পড়তেন। আমি নিজে কী চাই, তা ঠিক ভাবে জানলে পথ আপনি বেরিয়ে আসে। আত্মানং বিদ্ধি— কথাটার মধ্যে, বৃহত্তর দার্শনিক তাৎপর্য ছাড়াও, এই সরল অর্থটাও আছে। |
0 comments:
Post a Comment