Total Pageviews

Sunday, June 12, 2011

স্বপ্নচূড়ায় সালমান


undefined
ছোট্ট একটা ঘর। দেয়ালগুলো ছাওয়া হালকা সবুজ রঙে। বইপত্রে ঠাসা পুরো জায়গাটা। একটা টেবিল, কাঠের গদিওয়ালা চেয়ার, প্রিন্টার আর কম্পিউটার—ঘরের আসবাব বলতে এগুলোই। এখানেই দিনমান কাজ করে যান টগবগে যুবক সালমান খান। অনেক দায়িত্ব তাঁর। বুক ভরা অনেক অনেক স্বপ্ন। প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য নির্ভর করে তাঁর ওপর। সংখ্যাটা কোটিতে নিয়ে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। লাখো অভিভাবকের আশীর্বাদ আছে সঙ্গে। কাজে গাফিলতি করার উপায় নেই তাই একদমই। ভোর হলেই জানালার কাচ ভেদ করে হুড়মুড়িয়ে আলো ঢোকে তাঁর ঘরে। ঘুমে ঢুলুঢুলু। সামান্য কিছু মুখে দিয়েই নিজের চেয়ারটাতে বসে যান তখন সালমান। মনিটরে চোখ রেখে ভাবতে থাকেন শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো নিয়ে। একটানা চলে কাজ। গণিত ও বিজ্ঞানের সমস্যা সমাধানের জন্য ইউটিউবে এক হাজার ৬৩০টি ভিডিও দিয়েছেন সালমান। প্রতিদিন কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রায় সত্তর হাজারবার সাহায্য নেয় এ ভিডিওগুলো থেকে। আনন্দদায়ক এক পদ্ধতিতে গণিত ও বিজ্ঞানের নিরস বিষয়গুলো আয়ত্ত করে নেয় সবাই। অল্প সময়ের ভেতর এত শিক্ষার্থীকে সহজ পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে পেরে আনন্দে ভরে যায় মন। সালমানের আনন্দে খুশি হন তাঁর স্ত্রী উমাইয়া মারভিও। চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় স্বামীর ওপর যে অভিমানটা ছিল এত দিন, উবে যায় তা নিমেষেই।

নাড়ির টানে
সালমান খানের দাদাবাড়ি বাংলাদেশের বরিশালে। তাঁর বাবা ডা. ফখরুল আমিন খান চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর দাদা আব্দুল ওয়াহাব খান ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার (১৯৫৫-৫৮)। সালমানের বাবা অভিবাসী হয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই লুইজিয়ানার নিউ অর্লিয়ন্স শহরে সালমানের জন্ম (১৯৭৭) এবং বেড়ে ওঠা। ১৯৯১ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বাবাকে হারান। নিজের চেষ্টাতেই সালমান আজকের এ অবস্থানে এসেছেন।
পড়াশোনায় বরাবরই ভালো সালমান। পাঠ্যপুস্তকের নিরস বিষয়গুলো আনন্দময় করে পাঠ করাটাই তাঁর কাৈশল। মেধাবী সালমান ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব আইটি (এমআইটি) থেকে গণিত, তড়িৎকাৈশল ও কম্পিউটার—এ তিন বিষয়ে স্নাতক করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎকাৈশলের ওপর সম্পন্ন করেন স্নাতকোত্তর। পড়াশোনা শেষ করেই শুরু হয় চাকরিজীবন। কিন্তু কেমন যেন একঘেয়ে সব। কোনো কিছু করেই পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যায় না। নতুন কিছু করতে হবে—এমন ভাবনাতেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সৃজনশীল মন।
অবশেষে আচমকাই চলে আসে সুযোগটা। ২০০৪ সালের দিকে বিয়ের পর বোস্টনে থিতু হন তিনি। পুরো পরিবার নিয়ে এ শহরে আসেন সালমানের মামা। তখনই জানা যায়, তাঁর মামাতো বোন নাদিয়া অঙ্কে খুব কাঁচা। অঙ্ক কষে সময় নষ্ট করার চেয়ে অন্য কাজে সময় ব্যয় করতেই ভালো লাগে তার। নাদিয়ার সঙ্গে কথা বলে সালমান বুঝতে পারেন, পাঠদানের বিষয়টি আনন্দদায়ক নয় বলেই পড়তে ভালো লাগে না বোনের। তখনই বোনকে পড়ানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করে অঙ্কের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন নাদিয়াকে। বোনটিও তাই অবশেষে সবকিছু ভুলে আটঘাট বেঁধে শুরু করে পড়াশোনা। দূরে থাকার কারণে টেলিফোন ও ইয়াহু ডুডল সফটওয়্যারের মাধ্যমে চলে পাঠদান। সফলতা আসে অল্প সময়েই। বিদ্যালয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালো ফলাফল করে নাদিয়া। নাদিয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুই ভাই আরমান ও আলীকেও পড়ানো শুরু করেন সালমান। পুরো ব্যাপারটা হয়ে যায় নেশার মতো। শিক্ষক হিসেবে এ নতুন কাজটা ভালো লাগে খুব। তবে সময় নিয়ে সমস্যায় পড়ে যান তিনি। চাকরি শেষে যখন তিনি বাড়ি ফেরেন, তখন আবার নাদিয়া ও তার ভাইয়েরা ব্যস্ত থাকে খেলাধুলা কিংবা পড়াশোনাসংশ্লিষ্ট অন্য কাজে। তাদের সঙ্গে সময় মেলানোটাই কঠিন। ভেবে ভেবে কিছুদিন পর এর সমাধান বের করে ফেলেন সালমান। গণিতের সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে ভিডিও তৈরি করে তা দিয়ে দেন ইউটিউবে। এর ফলে নাদিয়া ও তার দুই ভাই বাড়িতে বসে সহজেই পেয়ে যায় গণিতের কঠিন সব সমস্যার সমাধান। পাঠদানের এ নতুন পদ্ধতিই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে সালমানের দায়িত্বও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ভিডিওগুলো আরও উন্নত করার জন্য তিনি শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম। গণিতের পাশাপাশি জীববিদ্যা, অর্থনীতি, রসায়ন, ইতিহাস, শেয়ারবাজারসহ আরও নানা বিষয় নিয়ে তৈরি করা হয় ভিডিও।
‘আমি নিজেই ছাত্রজীবনে একঘেয়ে পাঠ্যপুস্তকের কারণে হতাশায় ভুগতাম। আনন্দময় হওয়া উচিত পাঠদানের পদ্ধতি। নিজের ভিডিওগুলোতে খুব সহজভাবে প্রতিটি সমস্যার সমাধান দিতে চেষ্টা করেছি। শিক্ষার্থীরা যাতে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে, সেদিকে ছিল আমার সজাগ দৃষ্টি।’ নিজের ভিডিওগুলো সম্পর্কে এভাবেই বলেন সালমান।
নিজের উদ্যোগটি বিশ্বব্যাপী সব শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। কোটি কোটি শিক্ষার্থী ভিডিওগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে উপকৃত হচ্ছেন, এতেই খুশি সালমান। অর্থের লোভ নেই তাঁর। তাঁর এ পদ্ধতি বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ করে দিতে চেয়েছিল অনেক কোম্পানি। বিনয়ের সঙ্গে সবাইকে ‘না’ করে দিয়েছেন তিনি। দু-একজনের সাহায্য নিয়ে তিনি ঠিক ঠিক চালিয়ে নিতে পারছেন পুরো প্রকল্পের কাজ। তাঁর ভিডিও টিউটরিয়ালগুলো ওপেনসোর্সে লাইসেন্সের অধীনে থাকায় যে কেউ এগুলো অনলাইন থেকে ডাইনলোড, অন্যকে বিতরণ, অনুবাদ প্রকল্প এবং এগুলো বাড়াতে পারবে। কয়েকটি দেশে এগুলো আঞ্চলিকীকরণ বা নিজস্ব ভাষায় অনুবাদ করার কাজও শুরু হয়ে গেছে। নিজের পুরো সময়টা এ কাজে দেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন সালমান। দিনরাত এখন শুধু তাঁর একটাই ভাবনা—আর কী করলে সফল হবে শিক্ষার্থীরা, আনন্দময় করে তোলা যাবে শিক্ষাজীবন।
পুরস্কারের কথা
মানুষ বাঁচে তাঁর স্বপ্ন নিয়ে। নিজের ভাবনা-চিন্তাগুলো দিয়ে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে পুরো পৃথিবীটা। তবে খুব অল্প কিছু মানুষ হয়ে ওঠেন সফল। এই গুটিকতক মানুষ ও তাঁদের চিন্তাভাবনাগুলো খুঁজে বের করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান গুগল। অসাধারণ সব পরিকল্পনা জনসমক্ষে আনার জন্য ঘোষণা করা হয় ‘প্রজেক্ট টেন টু দ্য হানড্রেড’ নামে ১০ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার। প্রতিষ্ঠানটির দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৮ সালে দেওয়া হয় এ ঘোষণা। এতে ১৭০টির বেশি দেশ থেকে জমা পড়ে এক লাখ চুয়ান্ন হাজার আবেদন। দুই বছরের যাচাই-বাছাই শেষে প্রথমে ১৬টি পরিকল্পনা নির্বাচন ও তার তালিকা তৈরি করে গুগল। পরে চূড়ান্তভাবে বেছে নেওয়া হয় পাঁচটিকে। নির্বাচিত প্রকল্পগুলোকে আরও বিস্তৃত করার জন্য দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থসহায়তা। শিক্ষা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে সালমানের ‘খান একাডেমি’র বিনা মূল্যে শিক্ষামূলক অনলাইন ভিডিও টিউটরিয়াল। একাডেমিটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০ লাখ ডলার পুরস্কার দিয়েছে গুগল। সালমানের কাজে মুগ্ধ বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস। তিনি ও তাঁর এগারো বছর বয়সী সন্তান ররি নিয়ম করে ইউটিউবে বসে গণিত বিষয়ে জানার জন্য। বিল গেটসকে শিক্ষার্থী হিসেবে পেয়ে দারুণ খুশি সালমান। স্বপ্নটা তাঁর পূরণ হতে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী মানুষ এখন যুক্ত হয়েছে তাঁর ভাবনাগুলোর সঙ্গে। ‘দারুণ খুশি আমি। আমার নাতি-নাতনিরাও আমার দেখা ভিডিও দেখে শিখতে পারবে—এটা ভাবতেই ভালো লাগছে।’ পুরস্কার পাওয়ার পর মজা করে বলেছেন সালমান খান। স্বপ্নের পেছনে ছুটলে একসময় তা আপনা-আপনি ধরা দেয় হাতের মুঠোয়। তাই ভুলেও বন্ধ করা যাবে না স্বপ্ন দেখা। এই সাফল্যের পর বাংলাদেশের এই তরুণকে নিশ্চয়ই অভিনন্দন জানিয়ে বলা যায়, শুধু তোমার নাতি-নাতনিই নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীই শিখবে এই ভিডিওগুলো থেকে। দূর হবে পড়াশোনা নিয়ে তাদের ভীতি।
সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে মাথাব্যথা নেই সালমানের। নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এখনো ব্যস্ত তাঁর ছোট্ট ঘরটায়। নিজের ঘরের জানালা থেকে আসা আলো একসময় মিইয়ে যায়। সময় বইতে বইতে নামে আঁধার। রাত গভীর হলেও কাজ থামান না তিনি। অনেক দূরের এক শহরে থেকেও তিনি ভাবেন বাংলাদেশ নিয়ে। এ ভাবনা যেন থেমে না যায় কখনোই..

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons