Total Pageviews

Saturday, June 11, 2011

‘মুসাআআআ! রোপ ধরে ওঠো’


undefined
স্বপ্ন নিয়ে পাতায় এভারেস্ট বিজয়ের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন মুসা ইব্রাহীম। আসুন তাঁর কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাক এই দুঃসাহসিক অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।
‘প্রথম বা দ্বিতীয় বলে কোনো কথা এখানে নেই। এটা এভারেস্ট। এতে আরোহণ করতে হয় ধীরে ধীরে এবং নিজের গতিতে।’ ২৩ জুন দিবাগত রাত ১২টার পর যখন আকাশে চাঁদ ঝলমলিয়ে উঠল, সেই প্রায় সাড়ে আট হাজার মিটার উচ্চতায় তেনজিং নোরগের এ কথা মনে পড়ছিল বারবার। বাংলাদেশ থেকে এভারেস্টে অভিযান পরিচালনা করতে হবে, দেশের লাল-সবুজ পতাকা এভারেস্টের চূড়ায় ওড়াতে হবে—ক্লাবের সেই অভিযানের সহযোদ্ধাদের কথা ভাবছিলাম। রিমি-রাইদের কথাও ঝিলিক দিয়ে মনে উদয় হচ্ছিল। ক্ষুদ্র পরিসরটা নিজের, কিন্তু এর সার্বিক অর্জন তো দেশের। দেশের জন্যই তো এ অভিযান। আরেকটা নতুন অভ্যুদয়। আরেকটা নতুন সূচনা এবং নিজের ক্ষেত্রে তা পুনর্জন্মের প্রসবপর্ব। সবই ছিল অনুপ্রেরণার বিষয়বস্তু। সুতরাং ২০১০ সালে এভারেস্ট অভিযানে যাত্রাটা সবার জন্য ছিল অবশ্যম্ভাবী। এক ধরনের প্রতিযোগিতাও। তবে তেনজিং নোরগে মননে, আরোহণে সঙ্গেই ছিলেন প্রেরণাদাতা হিসেবে। এভারেস্টের বেস ক্যাম্প ও অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পে তার ম্যান অব এভারেস্ট: অটোবায়োগ্রাফি অব তেনজিং নোরগে বইটি পড়ে এভাবেই শিহরিত হয়েছিলাম বারবার। আর ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে যে অভিযান শুরু হয়েছিল, ২৩ জুন ছিল সেই অভিযানের ৪৬তম দিন। বেস ক্যাম্পে পৌঁছানোর হিসাবে (১৪ এপ্রিল) তা ছিল ৪০তম দিন এবং প্রতিটি দিন ছিল নতুন করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার দিন। ‘আমিও পারি’ কথাটি প্রমাণ করার দিন।

এদিন সাড়ে আট হাজার মিটার উচ্চতায় সামিট আরোহণে আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করেই এগোচ্ছি। আগের দিন রাত আটটায় এই সামিট পুশ শুরু হয়েছে। তখন থেকেই ফিক্সড রোপে ক্রমাগত জুমার ক্লাইম্বিং চলছে। কখনো সেটা রক ফেইসে, আবার কখনো তা আইস ফেইসে। শুরুতে প্রায় ৫০ ডিগ্রি খাড়া ঢালে এই আরোহণ শুরু। এরপর প্রায় ২০০ মিটার পথ প্রায় খাড়া উঠে যাওয়ার পর সেই উচ্চতায় পর্বতের রিজের ঠিক মাঝে গিয়ে ঢালের সমাপ্তি। এই রিজ ডান বরাবর শেষ হয়েছে একেবারে এভারেস্ট চূড়ায় গিয়ে। অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প থেকে দেখতে তা ঘুড়ির একটা লেজের মতো, পিরামিডের মতো এভারেস্ট একটা ঘুড়ি, আর এই রিজ তার লেজ।
অন্যান্য আরোহীর মতো আমিও মাথায় হেডল্যাম্প লাগিয়ে একটানা আরোহণ করছি। অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পেই একটা দলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আরোহণের সময় যাতে কেউ পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য শুরু থেকেই আমরা—দুই শেরপা কৈলাস তামাং, লাকপা নুরু ও আমি অন্যান্য আরোহীর সমানতালে আরোহণ করব। কিন্তু সেই রিজে খানিক থামলাম সিলিন্ডারে পর্যাপ্ত অক্সিজেন রয়েছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য।
‘মুসা, থামো। অক্সিজেনটা পরীক্ষা করা দরকার।’
‘ঠিক আছে কৈলাস। চেক করো।’
এতক্ষণ ধরে ক্রমাগত আরোহণ করায় বুকটা হাঁপরের মতো ওঠা-নামা করছিল। অক্সিজেন রেগুলেটর আড়াই থেকে ‘থ্রি লিটার পার আওয়ার’-এ সেট করায় সেটা কমে এল। কিন্তু অক্সিজেন চেক করার জন্য থামার কারণে মুহূর্তেই অন্য দলের শেরপা ও আরোহীসহ মোট ছয়জন পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। জিদ চেপে গেল যে এমনটা আর হতে দেওয়া যাবে না। সুতরাং সেই দলের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে রিজের ভাঁজ পার হচ্ছিলাম হেডল্যাম্পের আলোয় সামনে যতটুকু দৃশ্যমান, তা দেখে।
ঘড়িতে কয়টা বাজে, হুঁশ নেই। আট হাজার ৫৫০ মিটার উচ্চতায় সেই মুহূর্তে পর্বতারোহীরা ওপরে, কিন্তু মেঘের ভেলা অনেক নিচে। খেয়াল করলাম, চাঁদ মাথার ওপর হাজির তার তিন-চতুর্থাংশ অবয়ব নিয়ে। আর এত উচ্চতায় চাঁদ অনেক কাছে চলে আসায় তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাকানো যাচ্ছে না বেশিক্ষণ। হঠাৎ দেখি সুউচ্চ সব পর্বত উঁকি দিচ্ছে বিস্তীর্ণ মেঘের ভেলার ভেতর দিয়ে। আর চিরচির বাতাসে যেই একেকটি মেঘের ভেলা সামান্যও কেঁপে ওঠে, মুহূর্তেই দেখি চমকানো বিদ্যুৎ সেই ভেলার ওপর পড়ে পুরো ভেলায় থাকা সাদা মেঘকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলছে। অসাধারণ অপার্থিব। দেখে প্রতিবার বিমোহিত হচ্ছি।
এতক্ষণ প্রায় ফুট ১৫ উচ্চতার ৯০ ডিগ্রি খাড়া পর্বতের পাথুরে গায়ে ফার্স্ট স্টেপ পার হয়ে এলাম। বাঁ হাতে জুমার ঠেলে আর ডান হাতে পুরোনো পতিত রশি পাকড়ে উঠলাম প্রথম ধাপের মাথায়। এবার আট হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতায় দ্বিতীয় ধাপ পার হওয়ার পালা। পুরোটাই ‘রকি ফেস’। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার ফের ৯০ ডিগ্রি খাড়া সেই দ্বিতীয় ধাপের গায়ে চায়নিজ শেরপারা একটা অ্যালুমিনিয়ামের মই লাগিয়েছে বটে। কিন্তু মইটা ঝুলছে সেই রক ফেস যেখান থেকে শুরু হয়েছে, তার ফুট দশেক ওপরে। আবার শেষও হয়েছে রক ফেস শেষ হওয়ার পাঁচ ফুট আগে। সেই পাঁচ ফুট আবার ওভারহ্যাং। বিপদের তো দেখি শেষ নেই।
প্রথম ১০ ফুট আগের মতো জুমার ঠেলে ও পুরোনো রশি পাকড়ে পার হলাম। মই দিয়ে পার হলাম আরও ১৫ ফুট। কিন্তু শেষের পাঁচ ফুট পার হতেই দফারফা। রক ফেইসে এই ওভারহ্যাংয়ের মুণ্ডুপাত করছি মনে মনে। কারণ একে ট্যাভার্স (পাশ কাটানো) করতে হবে। কিন্তু সেটাই আর করতে পারছি না। সেই মুহূর্তে ভুলে গেছি পুরোনো রশি পাকড়ে ধরতে। শুধু জুমার ঠেলে আর পাথরের ওপর ক্র্যাম্পন ঠেকিয়ে উঠে যেতে চেষ্টা করছি। কিন্তু ক্র্যাম্পন বারবারই পিছলে যাচ্ছে। পতন ঠেকাতে ডান হাত দিয়ে জুমার ঠেলা বাদ দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছি। এ মুহূর্তে সেফটি অ্যাংকর ক্যারাবিনা নয়, জুমার আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। ঝুলে আছি জুমারের ওপর। সেফটি অ্যাংকর শুধু শরীরকে এদিক-ওদিক দুলুনি থেকে রক্ষা করছে। পুরো শরীরের ভার জুমারের ওপর। মিনিটখানেক ধরে ডান হাতে জুমার ধরে আছি। ফলে হাত ব্যথা করতে শুরু করল। ব্যথায় আর পারলাম না, জুমার ছেড়ে হাত ঝাঁকাচ্ছি।
এবার শুরু হলো কৈলাসের চিৎকার।
‘মুসাআআআআ!!! রোপ ধরে ওঠো, রোপ ধরে ওঠো।’
তার চিৎকার শুনে হেডল্যাম্পের আলোয় রশি খোঁজা শুরু করলাম। এদিকে হেডল্যাম্পের আলোও অনেকটা কমে এসেছে। দুই পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজছি রশি। এদিকে আরোহী আর শেরপাদের একটা লম্বা সারি তৈরি হয়েছে। তারা অপেক্ষা করছে কখন আমি পার হয়ে যাব সেই ওভারহ্যাং।
‘মুসা!! রোপটা খুঁজে পাচ্ছ না? তুমি কি নিচে নেমে যেতে চাও? তুমি বাড়ি ফিরে যেতে চাও?’

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons