Total Pageviews

Saturday, June 11, 2011

রক্তাক্ত হাসকি কোলে নিয়ে স্লেজে ফিরে গেলাম


undefined
‘হাসকিদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ো, এর মুখ থেকে ওকে ছাড়িয়ে নাও, রক্ত দেখে ভয় পেয়ো না, হাত লাগাও, হার্নেস ধরে টান মারো, একে সরাও, ধরো ওটাকে।’ দলনেতা রবার্ট উন্মত্ত কুকুরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে করতে পাগলের মতো চিৎকার করে আমার উদ্দেশে এসব কথা বলল। আমাদের দুই স্লেজের কুকুর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ১২টি হাসকির গর্জনে কানে তালা লাগছে, মুলার মতো দাঁত ঢুকে যাচ্ছে কারও পেটে-পিঠে। পায়ের তলায় হিমবাহের সাদা জমি কুকুরের রক্তে লাল। রবার্ট যতই চেঁচাক, এক ডজন সংগ্রামী হাসকির মাঝে সশরীরে দাঁড়ানো কি সোজা কথা! কিন্তু আমারই ‘পদস্খলনে’ শুরু হয়েছে এ হাসকি-লড়াই, এখন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে তো থাকতে পারি না। বিকশিত দাঁতের বীভৎস সারি অগ্রাহ্য করে ভূলুণ্ঠিত একটা হাসকিকে টেনে সরালাম। অমনি তার ক্ষিপ্ত প্রতিপক্ষ ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। তার ভারে আমি ধরাশায়ী হলাম। চরকির মতো চার হাত-পা চালিয়ে রবার্ট দুই দল হাসকির মধ্যে কোনোমতে এক যুদ্ধবিরতি রেখা কায়েম করল। সেই নো-ডগ্স-ল্যান্ডে আমি রক্তাক্ত হাসকি কোলে নিয়ে বসে রইলাম।
বুক ধড়ফড় কমে গেলে মাথা তুলে দেখি, দূরে হিমবাহের ঢালে স্লেজ থামিয়ে আর সব অভিযাত্রী অপেক্ষা করছে। আমরা দশ অভিযাত্রী ছয় স্লেজ নিয়ে লঙইয়ারবেন ছেড়েছি ঘণ্টা চারেক আগে। উত্তর মেরু থেকে মাত্র ১০ ডিগ্রি দূরে স্ভালবার্ড দ্বীপ; দ্বীপের একমাত্র শহর লঙইয়ারবেন—বিশাল হিমবাহের কোণে খুদে এক জনপদ। কিছু গবেষক, পর্যটক আর অভিযাত্রী আসে, তাই এ ডিপ-ফ্রিজে বসতি টিকে আছে। এখানে গবেষক আসে হিমবাহ, উত্তুরে আলো আর মেরু ভালুক পর্যবেক্ষণ করতে। পর্যটক আসে মধ্যরাতের সূর্য, অথবা ‘উত্তুরে আলো’ নামে খ্যাত মেরুর আকাশে নীল আলোর ঝালর দেখতে। হাতেগোনা কিছু অভিযাত্রীও আসে; এপ্রিলে এখানে উত্তর মেরু অভিযান শুরু হয়, মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় স্কি ম্যারাথন।
উত্তর মেরু অভিযাত্রী হিসেবে আমরা স্ভালবার্ড দ্বীপে যাত্রাবিরতি করছিলাম। আজ ছিল আমাদের স্লেজ চালানোর হাতেখড়ি। যাত্রার আগে রবার্টের কাছে স্লেজ চালানোর তালিম নিয়েছি। আধঘণ্টার ট্রেনিং—প্লাস্টিকের কুকুর টেবিলে রেখে সে দেখিয়েছে কী করে হাসকির গায়ে হার্নেস পরিয়ে স্লেজে জুড়তে হয়। জেনে নিয়েছি কী করে স্লেজের ডান পাশে ভর দিলে হাসকি ডানে মোড় নেয়, বাঁ পাশে ভর দিলে হাসকি বাঁয়ে মোড় নেয়। স্লেজ থেকে স্লেজের সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখার কথা রবার্ট পঁইপঁই করে বলে দিয়েছে। বলেছে, দুই স্লেজ কাছে এলে দুই দল হাসকির মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই বেধে যেতে পারে।
শুরুতে সবই ভালো ছিল। হার্নেস পড়তে হাসকির কোনো অনীহা নেই, ছুটে চলতে নেই কোনো ক্লান্তি। মহানন্দে ছয়টি হাসকি স্লেজে জুড়ে তীরবেগে ছুটে চললাম। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে গেলাম। দিকচিহ্নহীন হিমবাহে স্লেজ তরতর করে এগিয়ে চলল। কিন্তু এ ভয়াবহ বরফের রাজ্যে রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা তত টেকসই নয়। রক্ত হিম করা বাতাসে স্লেজ হাঁকানোর ফলে নভোচারীর নিশ্ছিদ্র পোশাকে ঢাকা শরীরও দ্রুত অবশ হয়ে পড়ল। একসময় স্লেজের সরু পাটাতন থেকে পা ফসকে আমি পপাত ধরণিতলে; আর ভারমুক্ত স্লেজ নিয়ে মহাবেগে ছুটে গিয়ে আমার হাসকিরা সব চড়াও হলো সামনের স্লেজে। শুরু হলো দক্ষযজ্ঞ। আমি আর রবার্ট ছুটে গিয়ে হার্নেস টেনে ধরার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
যুদ্ধ শেষ হলে দুই মিনিট দম নিয়ে রবার্ট এসে বলল, ‘ওঠো, রওনা দেওয়া যাক। অনেক হাসকি আহত হয়েছে, তবে স্লেজ টানতে পারবে। শুধু একে ছুটতে দিলে রক্তক্ষরণে মারা যাবে, এটাকে কোলে নিয়ে তুমি স্লেজে গিয়ে বসো। বাকি পাঁচ কুকুর দিয়ে স্লেজ চলবে।’ আমি আমার সাফাই গাইতে উঠে বললাম, ‘স্লেজ থেকে পা ফসকালে যে এমন খুনোখুনি হবে, তা বুঝিনি।’ রবার্ট বলল, ‘পড়লে তো পড়লে, স্লেজ ছাড়লে কেন? হাত দিয়ে স্লেজটা ধরে রাখলে হাসকির দল তোমাকে ছেঁচড়ে নিয়ে বেশি দূর যেতে পারত না। এ পোশাকে বরফের ওপর দু-এক কিলোমিটার গড়িয়ে গেলে কি কোনো ক্ষতি ছিল!’
আমি মাথা নিচু করে রক্তাক্ত হাসকি কোলে নিয়ে স্লেজে ফিরে গেলাম। মনে হলো, ভেতরে ভেতরে হাসকির চেয়ে আমি কম আহত নই।

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons