Total Pageviews

Sunday, June 12, 2011

‘আর এগিয়েছ কি মরেছ’


undefined
‘এই, হ্যালো, পিছে হটো, পিছে হটো, আর এগিয়েছ কি মরেছ।’ সাহেবি ভদ্রতার ধার না ধেরে অভিযাত্রীদের কানে তালা লাগিয়ে চিৎকার করে দলপতি বলল, ‘শিগগির পিছে আসো, পিছে চলে আসো, ওভার-হ্যাং ভেঙে পড়বে।’ আমার উদ্দেশেই এত সব চেঁচামেচি, আমিই ফালমারের ফটো তোলার জন্য দলছুট হয়ে হিমবাহের প্রান্তে চলে এসেছি। আর সব অভিযাত্রী লাঞ্চ-প্যাকেট নিয়ে দলপতির পাশে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছেন। সকালে লঙ্গিয়ার্বেনের উষ্ণ আস্তানা ছেড়ে অন্তহীন হিমবাহে নেমে টানা চার ঘণ্টা আইস-স্কুটার হাঁকিয়ে সবাই ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, স্তিমিত; ইতিউতি তাকানোর উৎসাহ নেই কারও, শুধু এই রাইফেলধারী হামবড়া দলপতিটা ছাড়া।
আমারও উৎসাহ ছিল না হিমবাহের কার্নিশে ঝুল-বারান্দার মতো লটকে থাকা জমাট বরফের ওভার-হ্যাং কত ভর নিতে পারে, তা পরখ করার। চার ঘণ্টা আইস-স্কুটারের ক্লাচ ধরে রাখার পর লাঞ্চের ঠোঙা ছেঁড়ার জোরটুকুও ছিল না আঙুলে। আমরা বারেন্টস আর গ্রিনল্যান্ড সাগরের উত্তরে চির-শুভ্র দ্বীপপুঞ্জ সভালবার্ডের হিমবাহ পার হচ্ছি। এপ্রিলের ১১ তারিখ, এখন এখানে ২৪ ঘণ্টা দিনের আলো। বরফ-ঢাকা চড়াই-উতরাই পার হওয়ার জন্য আইস-স্কুটার অসাধারণ এক বাহন; কিন্তু মুশকিল হলো, সারাক্ষণ এর ক্লাচ চেপে ধরে রাখতে হয়, ক্লাচ ছাড়লেই চলা বন্ধ। যাত্রী পড়ে গেলে তৎক্ষণাৎ স্কুটার নিশ্চল করার জন্যই এ ব্যবস্থা। ক্লাচ ধরার সহজ কাজটুকু এ মহা হিমের জগতে যে কী এক জ্বালাতন, তা দুই হাতের শীতল ও অচল পেশিগুলো প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছিল। তাই একটু শ্যাডো-বক্সিং করে জমাট পেশি সচল করার মতলবে দল থেকে সরে হিমবাহের কার্নিশের দিকে হাঁটা দিয়েছিলাম।
দুই মিনিট হাঁটার পর হঠাৎ দেখলাম, একঝাঁক ফালমার উড়ে এসে কার্নিশের নিচে ঢুকে গেল। সম্ভবত এরা ‘উত্তুরে ফালমার’। উত্তর মেরুর ১০ ডিগ্রির মধ্যে টিকে থাকা প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী পাখি। ভার কমানোর জন্য দুরবিন রেখে এসেছি, খালি চোখে দেখে শনাক্ত করতে হলে আরও কাছে যেতে হবে। শতাধিক কিটিওয়েক ও ফালমার বারবার কার্নিশের নিচে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। বরফের নিচে নিশ্চয়ই এদের বাসা করার মতো শক্ত পাথুরে দেয়াল রয়েছে। আশা করি আমার ভারে ভেঙে পড়ার মতো নাজুক হবে না বরফের ওভার-হ্যাং। মেরু ম্যারাথন সম্পন্ন করে উত্তর মেরু থেকে সদ্য ফিরছি বলে আমি কিছুটা ঘোরের মধ্যে আছি, মনে হচ্ছে ওভার-হ্যাং ভেঙে পড়লেও ৫০০ মিটার নিচে বরফ-ঢাকা ইসফোর্ডেন সৈকতে আছড়ে পড়ে মরব না, স্ফীত-বুকে ফালমারের সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়াব।
ফেস্টনিঞ্জেন সৈকতে বরফ ফুটো করে বেরিয়ে আসা রিং-সিল আর ওয়ালরাশের ছবি তুলতে গিয়ে টেলি-লেন্সসহ আমার ভারী-ক্যামেরা ঠান্ডায় জমে অচল হয়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে জ্যাকেটের পকেটে লুকানো খুদে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। বাংলাদেশের দ্বিতীয় অভিযাত্রী তারেক অনুও তাঁর ক্যামেরা নিয়ে আমাকে অনুসরণ করছে। বুঝতে পারছি, একটু বেশিই ঝুঁকি নিচ্ছি; কিন্তু এগিয়ে না গেলে এই খেলনা-ক্যামেরায় কি আর ভালো ছবি আসবে! আমরা এগোচ্ছি আর ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক করছে। কিন্তু মনমতো ছবি নেওয়ার আগেই হতভাগা দলপতির নজর পড়ল এদিকে, আর শুরু হলো তার অশোভন হাঁকডাক। আমরা সুবোধ বালকের মতো অ্যাবাউট-টার্ন করলাম। তবে মনে মনে দলপতিকে শ্রাদ্ধ করতে ছাড়লাম না, ‘মেরু ভালুকের ভয়ে কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে নিজেকে জেনারেল মনে করেছেন নাকি; আরে বাবা, কার্নিশে কতটুকু ঝুঁকি তা কি আমরা বুঝিনে, আমি মরলে আপনার বউ কি বিধবা হবেন!’
আমরা ফিরে এলে একে একে সব আইস-স্কুটার স্টার্ট হলো। এবার অবতরণ, প্রায় ৭০ ডিগ্রি ঢাল দিয়ে নেমে আসা। মনে হয় এই বুঝি আইস-স্কুটার উল্টে যাবে; কিন্তু যায় না—এমনকি আমার মতো নব্য চালকের হাতেও এর বিশাল বেল্ট বরফ আঁকড়ে তর তর করে এগিয়ে চলে। হিমবাহ থেকে নেমে শুরু হলো বরফ-ঢাকা ইসফোর্ডেনের ওপর দিয়ে মনোহর ড্রাইভ। হিমবাহের যে কার্নিশে আমরা উঠেছিলাম, তা এখন আমাদের মাথার ওপরে। মনে হয় যেন বরফের এক বিশাল কাস্তে আকাশে ঝুলে আছে। ওপর থেকে দেখে আমরা মোটেই বুঝিনি কত ঠুনকো আর ভঙ্গুর এই ওভার-হ্যাং। না বুঝে কিছু আগে এর প্রায় শেষ মাথায় গিয়ে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। এখন সে স্থানটি দেখে শরীরে শীতল-ঘাম বয়ে গেল; দলপতির প্রতি আমার চাপা ক্ষোভ গলে সৈকতের তুষারে মিশে যেতে মোটেই দেরি হলো না।

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons