Total Pageviews

Friday, June 10, 2011

কপাল খুলে দিয়েছে বাদাম


undefined
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বাদাম চাষে সাফল্যে হাসি ফুটিয়েছে শত শত পরিবারের মুখে
ছবি: প্রথম আলো

জন্মের কয়েক মাস পর মো. সাইদুজ্জামানের মা মারা যান। দেড় বছর বয়সে হারান বাবাকে। বেড়ে ওঠেন দাদির কাছে। একমুঠো ভাতের জন্য আট বছর বয়সে গরুর রাখাল হন। কোনো কাজ না পেয়ে একপর্যায়ে শুরু করেন দিনমজুরি।
সেই সাইদুজ্জামান বাদামের চাষ করে নিজের ভাগ্য বদল করেছেন। বাদাম চাষের নীরব বিপ্লব ঘটেছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা নদীর চরে। আজ ১৩ একর জমি ও পাকা বাড়ির মালিক সাইদুজ্জামান। তাঁর দান করা এক একর জমিতে এখন বসবাস করছে পাঁচ শতাধিক ভূমিহীন। তাঁর পরামর্শে বাদামের চাষ করে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের শত শত লোক আজ স্বাবলম্বী।
সাইদুজ্জামানের খোঁজে: সাইদুজ্জামানের বাড়ি কাউনিয়া উপজেলার টেপা মধুপুর ইউনিয়নের বিশ্বনাথচরে। কাঁচা-পাকা পথ ধরে বিশ্বনাথচরে ঢোকার মুখেই চোখে পড়ে মাঠের পর মাঠজুড়ে বাদামখেত। কেউ জমি থেকে গাছসহ বাদাম তুলছে, কয়েকজন বাদাম আলাদা করছে গাছ থেকে। কেউ আবার বাদাম শুকাচ্ছে রাস্তার পাশে। কিছু দূর যেতেই দেখা যায়, নিজের জমিতে বাদাম তুলছেন সাইদুজ্জামান; সঙ্গে কাজ করছে তিন সন্তান ও দিনমজুরেরা। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সাইদুজ্জামান জমি থেকে আলে উঠে আসেন। তারপর বলে যান সংগ্রামী জীবনের কাহিনি।কষ্টের অতীত: ১৯৫১ সালে দরিদ্র পরিবারে জন্ম সাইদুজ্জামানের। জন্মের তিন মাসের মাথায় মা মারা যান। দেড় বছর বয়সে হারান বাবাকে। দাদি তাঁকে লালন-পালন করেন। ১৯৫৯ সালে দাদি মারা গেলে সাইদুজ্জামান অসহায় হয়ে পড়েন। একমুঠো খাবারের জন্য তাঁকে ঘুরতে হয় প্রতিবেশীদের দুয়ারে।
এর পরের কাহিনি জানা যাক সাইদুজ্জামানের মুখ থেকে, ‘আট বছর বয়সে একমুঠো খাবারের জন্য রাখালের কাজ করি। দুই বেলা খাবারের বিনিময়ে সারা দিন দুটি গরুকে ঘাস খাওয়াতাম। গরুর পেট ভরলে দুই বেলার খাবার পেতাম, না ভরলে এক বেলার। একদিন একটি গরু অন্যের খেতে গেলে গরুটি খোঁয়াড়ে দেওয়া হয়। গৃহকর্তা আফাজ উদ্দিন আমাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন।’ তিনি বলেন, ‘মার খেয়ে যাই কাউনিয়া বাজারে। ক্ষুধার তাড়নায় সেখানে রাস্তার পাশে গাছের নিচে বসে কাঁদছিলাম। কাউনিয়া সদরের যুবক নাসির উদ্দিন আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। পরের দিন আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার সিঙ্গেরগাড়ী গ্রামের জহুর হুজুরের কাছে। তিনি আমাকে সিঙ্গেরগাড়ী মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। তাঁর বাড়িতে ছয় বছর গরুকে ঘাস খাওয়ানোর পাশাপাশি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ি। এরপর বিভিন্নজনের বাড়িতে গৃহশিক্ষক থেকে ১৯৭০ সালে দাখিল ও ১৯৭২ সালে আলিম পাস করি। ১৯৭৩ সালে নিজ গ্রামে ফিরি।’
সাইদুজ্জামান জানান, চাকরি না জোটায় বিয়ের পর তিনি শুরু করেন দিনমজুরি। এলাকায় কাজ না পেয়ে ছুটে যান লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা গ্রামে। সেখানে খায়রুলের বাড়িতে কাজ নেন বাদাম তোলার। খায়রুল তাঁকে বাদাম চাষের পদ্ধতি শেখান।
বাদামের খেতে: খায়রুলের বাড়িতে চার মাস কাজ করে বাড়ি ফিরে সাইদুজ্জামান ১৯৭৬ সালে ৩২ শতক জমি বর্গা নিয়ে বাদামের চাষ শুরু করেন। বাদাম বিক্রি করে তাঁর লাভ হয় এক হাজার ৬০০ টাকা। এরপর সাইদুজ্জামান পুরোপুরি বাদাম চাষে লেগে পড়েন। সংসারে আসে সচ্ছলতা। বাদাম চাষের আয়ের টাকায় কেনেন ১৩ একর জমি। বানান পাকা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে লাগান ফলের গাছ। মাছ চাষের জন্য খনন করেন তিনটি পুকুর। পাঁচটি গরুর একটি খামারও করেন। তাঁর তিন ছেলে লেখাপড়া করে। অপর তিন ছেলে লেগে আছে বাদাম চাষে। এবার তিনি ১০ একরে করেছেন বাদামের চাষ। ইতিমধ্যে এক একরের বাদাম বিক্রি করে পেয়েছেন ৩৫ হাজার টাকা।
সফল যাঁরা: বিশ্বনাথচরের কৃষক রেজাউল ইসলাম জানান, তাঁর কোনো জমি ছিল না। জানতেন না লেখাপড়া। সাইদুজ্জামানের পরামর্শে ১৯৯০ সালে ৩০ শতক জমি বর্গা নিয়ে বাদামের চাষ শুরু করেন। ২০ বছর ধরে বাদাম চাষের আয় দিয়ে তিনি নয় একর জমি কিনেছেন। পাকা বাড়ি করেছেন।
কৃষক জয়নাল আবেদীন এবার নয় একর জমিতে বাদাম লাগিয়েছেন। জয়নাল বলেন, ‘ধানের চেয়ে বাদামে লাভ দ্বিগুণ। তাই এই মৌসুমে ধানের বদলে বাদামের চাষ করি। অন্য মৌসুমে বৃষ্টির জন্য পারি না।’
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য প্রাণনাথচরের আবদুল কাদের এখন সফল বাদাম চাষি। তিনি জানান, ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে আমন ধান ওঠার পরপরই বাদামের চাষ শুরু হয়। মাটির নিচে ফলন হওয়ায় পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম। প্রতি একরে বাদাম চাষে খরচ হয় ১২-১৩ হাজার টাকা, খরচ বাদে আয় হয় ৩৬-৩৭ হাজার টাকা।
হায়াত খান চরের সাবেক ইউপি সদস্য আজিজুল ইসলামও একজন বাদাম চাষি। তিনি জানান, মে-জুলাই মাসে বাদাম তোলা হয়। একরে ২৪-২৫ মণ বাদাম উৎপাদন হয়। দুবার রোদে দেওয়ার পর প্রতি মণ বাদাম ২৪০০-২৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
একইভাবে ওই গ্রামের দিনমজুর হাকিমুদ্দিন, কৃষক হোসেন আলীসহ অনেকে বাদামের চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
পরিশ্রম কম, ঝামেলা নেই: নজিরদহ চরের কৃষক শফিকুল ইসলাম জানান, চরের প্রায় সব জমিতে আগে ধান, মরিচ, ডাল উৎপাদন হতো। ১৯৮৮ সালে বন্যার পর চরের জমিগুলো পলি কমে বেলে মাটির পরিমাণ বাড়তে থাকে। গাদাইচরের মোফাজ্জল হোসেন জানান, চরের বেলে-দো-আঁশ মাটি নরম। তিনবার লাঙল দিয়ে চষে জমিতে বাদামের বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। কয়েক মাস পর বাদামগাছ তুলে শিকড়ের সঙ্গে থাকা বাদামগুলো আলাদা করতে হয়। মাঝখানে জমিতে সার ও কীটনাশক দিতে হয় না। পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না বললেই চলে।
কর্মকর্তারা যা বলেন: উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, সাইদুজ্জামান বাদাম চাষের পথিকৃত। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ২০টি চরের দেড় হাজার কৃষক এবার এক হাজার ২৫০ একর জমিতে বাদামের চাষ করেছেন। এই বাদাম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘সাইদুজ্জামান আমাদের গর্ব। তাঁর পথ ধরে কৃষকেরা বোরো ধানের পরিবর্তে বাদামের চাষ করছেন। এতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বাদামখেতে সাত-আট ঘণ্টা শ্রম দিয়ে দিনমজুরেরা ২০০ টাকা করে পাচ্ছেন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা পারভীন বলেন, সাইদুজ্জামানের দান করা এক একর জমিতে ২০০৮ সালে সরকারিভাবে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়। এখানে শতাধিক ভূমিহীন পরিবার বসবাস করছে।
সাইদুজ্জামানের কথা: সাইদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামের অন্যরা আমার পরামর্শে বাদামের চাষ করে লাভবান হয়েছে। তারা আমাকে সম্মান করে—এটাই আমার চরম পাওয়া। তারা আমাকে ভোট দিয়ে ইউপি সদস্য বানিয়েছে।’ সাইদুজ্জামানের স্ত্রী আবেদা বলেন, ‘একদিন সমাজে আমাদের কোনো পরিচয় ছিল না। আজ আমি গর্ব বোধ করি।’

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons