Total Pageviews

Saturday, June 11, 2011

এভারেস্ট জয়ের সেই সকালটি


undefined
স্বপ্ন নিয়ে পাতায় এভারেস্ট বিজয়ের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন মুসা ইব্রাহীম। আসুন, তাঁর কাছ
থেকে জেনে নেওয়া যাক এই দুঃসাহসিক অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।
কৈলাসের কথা শুনে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে। সেই রক ফেসের ডান দিয়ে সরু একটা খাঁজ। তার ওপর ক্র্যাম্পন ঠেকিয়ে কোনোমতে পার হচ্ছি। এ পর্যায়ে এভারেস্টজয়ী ফিরতি দলের সঙ্গে একের পর এক সাক্ষাৎ হচ্ছে। তাদের যে অভিনন্দন জানাব, মনের সেই অবস্থাও নেই। সেই রাত আটটায় শুরু হয়েছিল ক্লাইম্বিং, এখন প্রায় ভোর। এর মধ্যে কোনো খাওয়া-দাওয়া নেই, পানিও খাওয়া হয়নি। তার পরও শরীরের শক্তির শেষবিন্দু ঠেলে দিচ্ছি পাহাড়ে ওঠার দিকে। মনের তাড়না ও জেদের প্রায় পুরো অংশ ব্যয় করছি। শুধুই ভাবছি—বিশ্বের কোনো একজন মানুষ এ কাজ পারলে তা আমিও পারব। এই ভেবে নিজেকে চাঙা রাখছি।
শেষ দিকে প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাড়া একটা ঢাল পেরোতেই চোখে পড়ল এভারেস্টের চূড়া। আমি আনন্দে আত্মহারা। সেটা মনের মধ্যে চেপে ধরে এগোতে শুরু করলাম।
এবার হেডল্যাম্প পুরোপুরি বেঁকে বসেছে। কোনো আলোই বেরোচ্ছে না হেডল্যাম্প থেকে। ভাবলাম—তাহলে এগোচ্ছি কী করে? পূর্ব দিগন্তে চোখ ফেরাতেই দেখি আকাশ ফরসা হয়ে আসছে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সেই আলোতেই যতটুকু পথ দেখা যায়, মনের অজান্তে তাকেই ভরসা ধরে নিচ্ছি। যাক, বাঁচা গেল তাহলে, নামার সময় তাহলে আর সমস্যা হবে না—মনে মনে ভাবছি।
আর মাত্র ৫০ মিটার ঢাল। পুরোটাই বরফ। দেখলাম, চূড়ার কাছে আরোহীদের লম্বা সারি। সামিট লাইন। সেই ঢাল পার হচ্ছি। আর মনে হচ্ছে যেন স্বপ্নের দিকে এগোচ্ছি। পাঁচ মিনিট, ছয়—সাত—আট—নয় মিনিটের মাথায় গিয়ে পৌঁছালাম এভারেস্টের চূড়ায়। লক্ষ্য পূরণ হলো। চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। চিৎকার করে বলতে মন চাইছে, ‘আআআমিইই পেরেছিইইই। বিশ্বের দম্ভ, সর্বোচ্চ চূড়া এখন বাংলাদেশের পায়ের নিচে। এক বাংলাদেশির কাছে এভারেস্ট হার মেনেছে।’ সাফল্য লাভের পর আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাঁর কাছে এও প্রার্থনা করছি, যেন নিরাপদে নামতে পারি।

সঙ্গে থাকা এক এভারেস্টজয়ীর কাছে সময় কত, তা জানতে চাইলাম।
‘জিরেল দাই, কয়টা বাজে?’
‘মুসা, এখন নেপাল সময় প্রায় চারটা ৫০। আর চায়নিজ সময় প্রায় আটটা।’হিসাব করে বুঝতে পারছি, এখন বাংলাদেশ সময় ভোর পাঁচটা পাঁচ।
চূড়ায় পৌঁছে শেরপাদের বুকে জড়িয়ে ধরছি। একে অপরকে অভিবাদন জানাচ্ছি আর চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছি। এই কাঁচা ভোরে এখনো সূর্য ভালো করে ওঠেনি। তাই চারদিকের সব পর্বত এখনো স্পষ্ট নয়। এ সময় দেখি, কৈলাস তাঁর জ্যাকেটের ভেতর থেকে ওয়াকিটকি বের করছেন। শুনলাম, তিনি অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্পে আমাদের এভারেস্ট জয়ের খবর পৌঁছে দিলেন।
এভারেস্টের চূড়ার দুই দিকেই সহজ ঢাল। চূড়ার জায়গাটা প্রায় ১৫-১৬ ফুট লম্বা আর প্রায় তিন-চার ফুট চওড়া। তেমন খাড়া বা বিপজ্জনক নয়। না হলেও আরোহী-শেরপা সবাই ফিক্সড রোপের সঙ্গে সেফটি লাগিয়ে সামিটে সাফল্য উদ্যাপন করছি।
আমার আগেই নেপালের ‘জিরেল’ সম্প্রদায়ের পর্বতারোহী লাল বাহাদুর সামিটে পৌঁছেছেন এবং তাঁর সম্প্রদায় থেকে তিনি প্রথম। আমার পরে মন্টেনেগ্রোর আরোহী স্ল্যাগি এসে হাজির। এমন সময় নেপালের দিক থেকে আরেক দল এসে চূড়ায় পৌঁছেছে। এ যেন এক মহারণ। তাতে সবাই জয়ী। সবার চেহারায় জয়ের ছটা (পরে জেনেছিলাম, তিব্বতের দিক থেকে প্রায় ৫৫ জন আরোহী ও শেরপা সেদিন এভারেস্ট জয় করেছিলেন এবং প্রথম সামিট হয়েছিল রাত তিনটায়)। হবেই তো, পর্বতারোহণের জগতে এভারেস্ট জয়ের গৌরব যে বিশ্ব অলিম্পিকে সোনা জয়ের সমমর্যাদার একটি বিষয়!
আর এটি তো শুধু এ ধরনের পার্থিব অর্জন মাত্র নয়, তা একজন মানুষের সারা জীবনের সাধনায় সফল হওয়ার মুহূর্ত। তার মাধ্যমে একটি দেশকে ভিন্ন মর্যাদায় উত্তরণের ক্ষণ। আর পর্বতারোহীর নতুন জন্মলাভ।
আমার অক্সিজেন বোতলে কতটুকু অক্সিজেন রয়েছে, কৈলাস ফের তা পরীক্ষা করছেন। জানালেন, যতখানি অক্সিজেন রয়েছে এতে সামিটের পর বেশ খানিকটা নামা যাবে। পিঠ থেকে ব্যাগপ্যাক নামিয়ে চূড়ার ওপর রেখে ভাবছি এবার ছবি তোলার পালা। কিন্তু ফের সমস্যা—ডাউন জ্যাকেটের ভেতরে রাখা ক্যামেরা বের করতে পারছি না। মাস্কে বাতাস চলাচলের পথ দিয়ে পানি (অক্সিজেন নেওয়ার সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যে জলীয় বাষ্প বের হয়ে আসে, তা মাস্কের গায়ে লেগে একসময় পানিতে পরিণত হয়। স্বাভাবিক বাতাস নেওয়ার জন্য মাস্কের গায়ে যে পথ রয়েছে, পানি সেই পথ দিয়ে বের হয়ে যায়।) ডাউন জ্যাকেটের ওপর এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা বরফে পরিণত হয়েছে তাপমাত্রা মাইনাসে থাকার কারণে। ফলে জ্যাকেটের চেইন পুরো বরফময় হয়ে আছে। চেইন তো আর নিচে নামে না। কী বিপদ! কী করা যায় বুঝতে পারছি না।
একপর্যায়ে গলা উঁচিয়ে ডাউন জ্যাকেটের গলার দিক থেকে ফিতা টেনে টেনে স্টিল ক্যামেরা বের করে আনছি। পুরোপুরি বের হতেই এভারেস্টের চূড়ায় ওড়ালাম বাংলাদেশের পতাকা। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। ছবি উঠল। এভারেস্টে যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে সেখানে প্রায় বছর তিনেক আগে এক শেরপার রেখে আসা বুদ্ধমূর্তির সঙ্গে ছবি তুলতে হয়। কিন্তু মূর্তিটিকে বৌদ্ধদের প্রার্থনা-পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়ায় তা আর দেখা যাচ্ছে না। এটাকে পেছনে রেখে সেভাবেই সবাই ছবি তুলছি। স্পনসরদের লোগো নিয়েও ছবি তোলা শেষ। হিসাব করে দেখলাম, প্রায় ২৫ মিনিট কেটে গেল। এবার নেমে যাওয়ার পালা।
এমন সময় পশ্চিমে তাকিয়ে দেখি, একি! দিগন্তে এভারেস্টের ছায়া পড়ে তা পিরামিডের মতো আকৃতি ধারণ করেছে! এও সম্ভব? অবিশ্বাস্য! এভারেস্টের চূড়া থেকে এমন দুর্লভ দৃশ্য এর আগে ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে—এমনটা কখনো শুনিনি। তাই শেষ মুহূর্তে ঝকমারি করে ফের ক্যামেরা বের করছি। সর্বশেষ এই ছবিটা তুলে নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সে সময় অনুভব করলাম যে আমি পেরেছি। সবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। বাংলাদেশের জন্য সত্যিই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। ভাবছি, যদি এখনই বাংলাদেশে উড়ে যাওয়া যায়, সবাইকে জানিয়ে দেওয়া যায় যে বাংলাদেশ পেরেছে। তার গর্বের পতাকা লাল-সবুজকে সেখানে পৌঁছানো হয়েছে। কিন্তু উড়ে যাওয়া তো সম্ভব নয়। যেভাবে এসেছি, একইভাবে ফিরতে হবে। এবার শুধু সেফটি ক্যারাবিনা রোপে লাগিয়ে নেমে যাচ্ছি দেশের পথে। এখন মনে পড়ছে একেবারে প্রথম দিনের কথা, শুরুর সময়কার কথা, কত ঝামেলা করে এসেছি এই অভিযানে।

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons