মাথা ঝাঁকিয়ে বরফ ঝেড়ে কুছ পরোয়া নেই ভঙিতে আমার গাইড বলল, ‘তুষার পড়লেই কি শেরপা থেমে যায়!’ কিছুক্ষণ ধরে তুষার ঝরছিল; এবার জোর বাতাস ছেড়েছে। তীরের মতো তুষারকণা এসে মুখে বিঁধছে। মাথার ওপর ছাতা ধরেও মুখ রক্ষা করা যাচ্ছে না, পালক-পোরা জ্যাকেটটি শুধু দেহ রক্ষা করে চলেছে। শেরপা গাইড ‘আঙ-কামি’ ছাতা আনেনি; ইমজােস ট্রেইলে অকাল তুষারপাতের কথাটা প্রস্তুতিপর্বে তার মনে ছিল না। ‘ছাতা ছাড়া তুমি এখন চলবে কী করে!’—এ কথা বলায় ঘাউড়ামি করে সে আরও জোরে পা চালাচ্ছে।
সাত দিন আগে লুকলা থেকে ইমজােস বেস-ক্যাম্পের উদ্দেশে আমাদের ট্রেকিং শুরু হয়েছে। মে মাসে অক্ষত দেহে এভারেস্ট বেস-ক্যাম্প ট্রেকিং শেষ করে স্ফীত আত্মবিশ্বাসে আমি ইমজােস অভিযান হাতে নিয়েছি। দুই বন্ধু আমার সঙ্গী হয়েছে; তাদের জীবনের প্রথম ট্রেকিং। এক-ট্রেকিং সিনিয়রিটি নিয়ে আমি তাদের ‘ওস্তাদ’ বনে গেছি। শুরু থেকেই অভিযানটির অবস্থা লেজেগোবরে; একটা না একটা অঘটন লেগেই আছে। প্রথম দিন পাঁচ কিলোমিটার পথ চলতে না চলতে এক বন্ধুর নতুন বুটজোড়ার সেলাই খুলে হা হয়ে গেল। মুখ ব্যাদান করা বুট দড়ি-দাড়া দিয়ে বেঁধে সে গুটি গুটি পায়ে ট্রেকিং করছে। তার সঙ্গে আমাদেরও শম্বুকগতি। দিন শেষ হলো, গন্তব্য এল না। বাধ্য হয়ে ‘ফাকডিং’-এর শেরপা-সরাইখানায় রাত কাটালাম; ‘জোরসালে’ যাওয়া হলো না। ভাগ্যক্রমে দুই দিন চলার মতো এক জোড়া পুরোনো জুতা মিলল সেখানে। জুতা আবিষ্কার করে বন্ধুবর চাঙা হলো; কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা রয়েই গেল। যথাস্থানে যাত্রাবিরতি হয়নি বলে পরদিনের গন্তব্য ‘নামচে-বাজার’ পৌঁছাতে সকাল-সন্ধ্যা টানা হাঁটতে হবে; মাঝে রাত্রিবাসের স্থান নেই।পরদিন দেখা গেল, আমার গতিই সবচেয়ে কম। গাইডকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধুরা এগিয়ে গেছে; অন্ধকারে পা টেনে টেনে আমি একা চলছি। তবে, রাত আটটায় সরাইখানায় এসে বুঝলাম, আগে হাঁটলেও বন্ধুদের হাল আমার চেয়ে ভালো নয়। এক বন্ধু সেদিনই তার অ্যাডভেঞ্চারে যতি টেনে ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। তাকে বিদায় দিয়ে ট্রেকিংয়ের তৃতীয় দিন আমরা দুই বন্ধু রাশি রাশি মেঘের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ‘খুম্জুঙ্গ’ পর্যন্ত উঠে গেলাম। তারপর পাহাড়ের উত্রাইয়ে গরগর করে নেমে গর্জনশীলা ‘ফুঙ্গি’ নদীর পাড়ে ‘ফুঙ্গিটেঙ্গা’ শেরপা-পাড়ায় রাতের ঠাঁই গাড়লাম। চমত্কার আবহাওয়া দেখে পরদিন ঠিক করলাম ‘তেংবোচে’ সরাইখানায় যাত্রাবিরতি না দিয়ে লম্বা ট্রেকিং করে এক দিনে ‘পাংবোচে’ পৌঁছাব। শুরুটা ভালোই ছিল; কিন্তু বিকেলে বৃষ্টি নামলে আমাদের গতি কমতে থাকল। রাত নেমে এল, ‘পাংবোচে’ এল না। পেটে চোঁ চোঁ খিদে নিয়ে ভিজে গায়ে জবুথবু হয়ে যখন ঘুমন্ত ‘পাংবোচে’ হাজির হলাম, তখন ডিনারের অপেক্ষায় জেগে বসে থাকার সাধ্যি আমাদের নেই।
বিচক্ষণ ট্রেকার হলে পরের দিনটি কেবল আহার আর বিশ্রামের জন্য বরাদ্দ করতাম। কিন্তু আমরা বিরতিহীন ট্রেকিংয়ে নেমেছি; বন্ধুকে শিগগির ঢাকা ফিরে কানাডা যেতে হবে। সকালেই বেরিয়ে পড়লাম; ‘ইমজাখোলা’ হিমবাহের বিধ্বস্ত পাড় দিয়ে কোনোমতে বেচে-বর্তে ‘ডিংবোচে’ গিয়ে নিশিযাপন করা গেল। সকালে আবার পথে নামলাম, গন্তব্য ‘চুখুং’। বৃক্ষহীন, ঊষর প্রান্তর; লম্বা মেঘের মুকুটপরা গগনবিদারি ‘আমা-দাবলাম’ শিখর দেখে আমাদের মাথা হেঁট। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আবহাওয়া বদলাচ্ছে; এই উষ্ণ রোদ, এই শিলাবৃষ্টি। বারবার পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে আমরা নাজেহাল। দুপুর নাগাদ চুখুং পৌঁছালে আমার বন্ধু রণে ভঙ্গ দিল; বলল, এটাই তার শেষ গন্তব্য হলে ভালো হয়। আমরা প্রায় পাঁচ হাজার মিটার উঁচুতে উঠে এসেছি। সমতলবাসী মানুষের প্রথম ট্রেকিংয়ের গন্তব্য হিসেবে মোটেই ফেলনা নয়। বন্ধুকে রেখে একাই ট্রেইলে নামলাম। গাইড ‘আঙ-কামি শেরপা’ আমার সঙ্গ নিল। গন্তব্য ইমজােস বেস-ক্যাম্প।
ঘণ্টা দুই হাঁটার পর তুষারপাত শুরু হলো। প্রথমে হালকা ছিল; পরে ঢল নামল। তুষার-তোড়ে আমার দুর্বল ছাতা কখন ভেঙে পড়ে, ঠিক নেই। আঙ-কামির দশা আরও কাহিল; তার ছাতা নেই, মাথায় টুপি নেই, পায়ে বুটের বদলে আছে স্যান্ডেল। ঝাপটার মুখে শেরপা-দম্ভ বিসর্জন দিয়ে বিশাল এক বোল্ডারের আড়ালে আশ্রয় নিল। এভাবে আধা ঘণ্টা দাঁড়ালে গাইড আর আমার পায়ের দুই-চারটা আঙুল খোয়া যেতে পারে। বাধ্য হয়ে ব্যাগের গহ্বর থেকে খুদে তাঁবুটা নিয়ে আমরা বরফের ওপর টানিয়ে দিলাম। হাস্যকর হলেও ওই মিনি-তাঁবুতে আমাদের ভালোই আশ্রয় হলো। আরও আধা ঘণ্টা তুষারপাত চলল। তুষারের নিচে আমাদের তাঁবু কবরস্থ হলেও বিধ্বস্ত হলো না। তুষারপতন ক্ষান্ত হলে চারদিক সুনসান; আমরা তাঁবুর চেইন খুলে শুভ্র তুষার-কবর থেকে জ্যান্ত বেরিয়ে এলাম।
সাত দিন আগে লুকলা থেকে ইমজােস বেস-ক্যাম্পের উদ্দেশে আমাদের ট্রেকিং শুরু হয়েছে। মে মাসে অক্ষত দেহে এভারেস্ট বেস-ক্যাম্প ট্রেকিং শেষ করে স্ফীত আত্মবিশ্বাসে আমি ইমজােস অভিযান হাতে নিয়েছি। দুই বন্ধু আমার সঙ্গী হয়েছে; তাদের জীবনের প্রথম ট্রেকিং। এক-ট্রেকিং সিনিয়রিটি নিয়ে আমি তাদের ‘ওস্তাদ’ বনে গেছি। শুরু থেকেই অভিযানটির অবস্থা লেজেগোবরে; একটা না একটা অঘটন লেগেই আছে। প্রথম দিন পাঁচ কিলোমিটার পথ চলতে না চলতে এক বন্ধুর নতুন বুটজোড়ার সেলাই খুলে হা হয়ে গেল। মুখ ব্যাদান করা বুট দড়ি-দাড়া দিয়ে বেঁধে সে গুটি গুটি পায়ে ট্রেকিং করছে। তার সঙ্গে আমাদেরও শম্বুকগতি। দিন শেষ হলো, গন্তব্য এল না। বাধ্য হয়ে ‘ফাকডিং’-এর শেরপা-সরাইখানায় রাত কাটালাম; ‘জোরসালে’ যাওয়া হলো না। ভাগ্যক্রমে দুই দিন চলার মতো এক জোড়া পুরোনো জুতা মিলল সেখানে। জুতা আবিষ্কার করে বন্ধুবর চাঙা হলো; কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা রয়েই গেল। যথাস্থানে যাত্রাবিরতি হয়নি বলে পরদিনের গন্তব্য ‘নামচে-বাজার’ পৌঁছাতে সকাল-সন্ধ্যা টানা হাঁটতে হবে; মাঝে রাত্রিবাসের স্থান নেই।পরদিন দেখা গেল, আমার গতিই সবচেয়ে কম। গাইডকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধুরা এগিয়ে গেছে; অন্ধকারে পা টেনে টেনে আমি একা চলছি। তবে, রাত আটটায় সরাইখানায় এসে বুঝলাম, আগে হাঁটলেও বন্ধুদের হাল আমার চেয়ে ভালো নয়। এক বন্ধু সেদিনই তার অ্যাডভেঞ্চারে যতি টেনে ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। তাকে বিদায় দিয়ে ট্রেকিংয়ের তৃতীয় দিন আমরা দুই বন্ধু রাশি রাশি মেঘের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ‘খুম্জুঙ্গ’ পর্যন্ত উঠে গেলাম। তারপর পাহাড়ের উত্রাইয়ে গরগর করে নেমে গর্জনশীলা ‘ফুঙ্গি’ নদীর পাড়ে ‘ফুঙ্গিটেঙ্গা’ শেরপা-পাড়ায় রাতের ঠাঁই গাড়লাম। চমত্কার আবহাওয়া দেখে পরদিন ঠিক করলাম ‘তেংবোচে’ সরাইখানায় যাত্রাবিরতি না দিয়ে লম্বা ট্রেকিং করে এক দিনে ‘পাংবোচে’ পৌঁছাব। শুরুটা ভালোই ছিল; কিন্তু বিকেলে বৃষ্টি নামলে আমাদের গতি কমতে থাকল। রাত নেমে এল, ‘পাংবোচে’ এল না। পেটে চোঁ চোঁ খিদে নিয়ে ভিজে গায়ে জবুথবু হয়ে যখন ঘুমন্ত ‘পাংবোচে’ হাজির হলাম, তখন ডিনারের অপেক্ষায় জেগে বসে থাকার সাধ্যি আমাদের নেই।
বিচক্ষণ ট্রেকার হলে পরের দিনটি কেবল আহার আর বিশ্রামের জন্য বরাদ্দ করতাম। কিন্তু আমরা বিরতিহীন ট্রেকিংয়ে নেমেছি; বন্ধুকে শিগগির ঢাকা ফিরে কানাডা যেতে হবে। সকালেই বেরিয়ে পড়লাম; ‘ইমজাখোলা’ হিমবাহের বিধ্বস্ত পাড় দিয়ে কোনোমতে বেচে-বর্তে ‘ডিংবোচে’ গিয়ে নিশিযাপন করা গেল। সকালে আবার পথে নামলাম, গন্তব্য ‘চুখুং’। বৃক্ষহীন, ঊষর প্রান্তর; লম্বা মেঘের মুকুটপরা গগনবিদারি ‘আমা-দাবলাম’ শিখর দেখে আমাদের মাথা হেঁট। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আবহাওয়া বদলাচ্ছে; এই উষ্ণ রোদ, এই শিলাবৃষ্টি। বারবার পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে আমরা নাজেহাল। দুপুর নাগাদ চুখুং পৌঁছালে আমার বন্ধু রণে ভঙ্গ দিল; বলল, এটাই তার শেষ গন্তব্য হলে ভালো হয়। আমরা প্রায় পাঁচ হাজার মিটার উঁচুতে উঠে এসেছি। সমতলবাসী মানুষের প্রথম ট্রেকিংয়ের গন্তব্য হিসেবে মোটেই ফেলনা নয়। বন্ধুকে রেখে একাই ট্রেইলে নামলাম। গাইড ‘আঙ-কামি শেরপা’ আমার সঙ্গ নিল। গন্তব্য ইমজােস বেস-ক্যাম্প।
ঘণ্টা দুই হাঁটার পর তুষারপাত শুরু হলো। প্রথমে হালকা ছিল; পরে ঢল নামল। তুষার-তোড়ে আমার দুর্বল ছাতা কখন ভেঙে পড়ে, ঠিক নেই। আঙ-কামির দশা আরও কাহিল; তার ছাতা নেই, মাথায় টুপি নেই, পায়ে বুটের বদলে আছে স্যান্ডেল। ঝাপটার মুখে শেরপা-দম্ভ বিসর্জন দিয়ে বিশাল এক বোল্ডারের আড়ালে আশ্রয় নিল। এভাবে আধা ঘণ্টা দাঁড়ালে গাইড আর আমার পায়ের দুই-চারটা আঙুল খোয়া যেতে পারে। বাধ্য হয়ে ব্যাগের গহ্বর থেকে খুদে তাঁবুটা নিয়ে আমরা বরফের ওপর টানিয়ে দিলাম। হাস্যকর হলেও ওই মিনি-তাঁবুতে আমাদের ভালোই আশ্রয় হলো। আরও আধা ঘণ্টা তুষারপাত চলল। তুষারের নিচে আমাদের তাঁবু কবরস্থ হলেও বিধ্বস্ত হলো না। তুষারপতন ক্ষান্ত হলে চারদিক সুনসান; আমরা তাঁবুর চেইন খুলে শুভ্র তুষার-কবর থেকে জ্যান্ত বেরিয়ে এলাম।
0 comments:
Post a Comment