Total Pageviews

Friday, March 23, 2012

গরিবের সহায় সাথী আপা

দিনাজপুরের চিবিরবন্দর উপজেলার সাতনালা গ্রামে কর্মীদের সঙ্গে নকশিকাঁথার কাজ করছেন সাথী দিনাজপুরের চিবিরবন্দর উপজেলার সাতনালা গ্রামে কর্মীদের সঙ্গে নকশিকাঁথার কাজ করছেন সাথী
প্রথম আলো
বাঙালি গৃহবধূ বলতে চট করে আমাদের চোখের সামনে নারীর যে চেহারা ফুটে ওঠে তা থেকে তিনি আলাদা। বাঙালি নারীর মতোই তিনি সহজ-সরল ও মার্জিত। তবে তাঁর কিছু বিশেষ গুণ আছে। তিনি সংগ্রামী, পরোপকারী এবং পরিশ্রমী। পরিশ্রম করে শুধু নিজেরই নয়, ৬০০ দরিদ্র নারীর সংসারের অভাব দূর করেছেন, দেখাচ্ছেন সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
এই গৃহবধূর নাম শামীমা আক্তার সাথী। সবার কাছে তিনি প্রিয় সাথী আপা। মেয়েদের পোশাক তৈরি দিয়ে শুরু পথচলার। পরে কাঁথা ও শিশুদের পোশাকে সুঁই-সুতা দিয়ে নকশার কাজ করে নজর কেড়েছেন সবার। প্রায় দিনই ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েন। কাজ নিয়ে ছুটে চলেন রংপুরের তারাগঞ্জ, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, খানসামা ও নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আবার ফেরেন বাড়িতে। দরিদ্র নারীদের দুঃখ ঘোচাতে এ যেন তাঁর ভিন্ন এক আন্দোলন।
শুরুর কথা: সৈয়দপুর উপজেলার সোনাখুলি গ্রামের শামসুদ্দিনের মেয়ে সাথীর বিয়ে হয় ১৯৯৮ সালে সৈয়দপুর শহরের পুরাতন বাবুপাড়া মহল্লার শামসুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে। বিয়ের সময় এই দম্পতি ছিল বেকার। শ্বশুরবাড়িতে সাথীর মনে হলো, বেকার জীবন সম্মানের নয়। তাই তিনি স্বামীকে ঢাকায় গিয়ে চাকরির সন্ধান করতে উদ্বুদ্ধ করেন। স্নাতক পাস সাথী নিজেও চাকরি খোঁজেন হন্যে হয়ে।
ঢাকায় স্বামী একটা চাকরি জোটালেও বেকারই থাকতে হলো সাথীকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। বাবার বাড়িতে মায়ের কাছে শিখেছিলেন সুঁই-সুতার কাজ। সেটা কাজে লাগিয়ে মেয়েদের পোশাক তৈরির জন্য একটি দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নেন। ভাবলেন, এখানে তৈরি করা পোশাক হবে আলাদা, যাতে থাকবে সুঁই-সুতার কাজ। পোশাকে ফুটে উঠবে প্রকৃতি, রূপকথা, দেশসহ নানা আকর্ষণীয় নকশা।
এই ভাবনা থেকেই ২০০০ সালে নিজ বাড়ির একটি কক্ষে দুটি সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু হয় কাজ। পুঁজি ছিল স্বর্ণালংকার বিক্রির ৫০ হাজার টাকা। বাড়ির একটি কক্ষে পোশাক বিক্রির জন্য ছোট একটি দোকান করেন, নাম দেন ‘লাল সবুজ’। ধীরে ধীরে এই পোশাকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। আয় ও ব্যবসার পরিধি বেড়ে যাওয়ায় সৈয়দপুর শহরের গ্যারিসন সিনেমা হল সংলগ্ন ক্যান্টনমেন্ট মার্কেটে বিক্রয়কেন্দ্র খুললেন। এর পাশেই রয়েছে একটি কারখানা।
নকশিকাঁথা: ২০০৬ সালে হঠাৎ করে সাথী নকশিকাঁথা তৈরির প্রস্তাব পান। এ কাঁথা তৈরিতে সময় ও শ্রম বেশি লাগে, আয়ও হয় বেশি। এ কারণে এ কাজের সঙ্গে গ্রামের দরিদ্র ও অভাবী পরিবারের নারীদের যুক্ত করার চিন্তা করেন সাথী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে নারীদের কাঁথা তৈরির কাজ শেখান। প্রকারভেদে একটি কাঁথা তৈরিতে তিন হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এসব কাঁথা দেশ-বিদেশে পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়ও বিক্রি হয়। গুণেমানে ভালো হওয়ায় সাথীর নকশিকাঁথার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। প্রসার বেড়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালে স্বামীকে ঢাকা থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন সাথী।
৭০০ মানুষের কর্মসংস্থান: সাথী আপার প্রতিষ্ঠান লাল সবুজে এখন ৭০০ দরিদ্র মানুষ কাজ করে। এদের ৯০ ভাগই নারী। এখানে নকশিকাঁথার কাজ বেশি হয়। পাশাপাশি মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, শিশুদের ফ্রক, থ্রি-পিছ, ফতুয়া, পাঞ্জাবিও তৈরি করা হয় তাঁর কারখানায়। প্রত্যেক নারীকর্মী প্রতি মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করেন।
কর্মীদের কথা: লাল সবুজে কাজ করে সংসারের অভাব দূর করেছেন সাবিনা বেগম, রেহানা পারভিন, গুড়িয়া বেগমের মতো অনেক অসহায় ও দরিদ্র নারী। গুড়িয়া বেগম জানান, চার বছর আগে তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। এক ছেলেকে নিয়ে বিপদে পড়েন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে সাথী তাঁকে কাজ দেন। এখন মাসে চার হাজার টাকা আয় করছেন।
সাথীর স্বপ্ন: তিনি ভবিষ্যতে সৈয়দপুর শহরে একটি বড় পোশাক কারখানা করতে চান। সেখানে দরিদ্র নারী ও কিশোরীরা কাজ করবে। সংসারের খরচ জোগাতে পুরুষদের সহায়তা করার জন্য তিনি নারীদের স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী করতে চান।
সংশ্লিষ্টদের কথা: সৈয়দপুর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোসলেম উদ্দিন জানান, কী করে ছোট্ট একটি সুঁই-সুতার কাজ বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়ে উঠতে পারে তা সাথীর কাছে শিখতে হবে। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা সাবিকুন্নাহার বলেন, ‘সাথী দরিদ্র নারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। আমরা তাঁকে সাধ্যমতো সহায়তা করব।’

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons