Total Pageviews

Friday, December 30, 2011

ধনেপাতায় ধনদৌলত

নিজের ধনেপাতা খেতে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ভেতরকুঠি গ্রামের তৈয়ব আলী
ছবি: প্রথম আলো
শীত মৌসুমে ধনেপাতার কদর বাঙালির ঘরে ঘরে। তরিতরকারিতে স্বাদ আনতে ধনেপাতার জুড়ি নেই। মচমচে মুড়ি, তেল-মরিচ-পেঁয়াজের সঙ্গে ধনেপাতা কুচি কুচি করে কেটে মেখে খেতে খুবই মজা। অনেকেই আছেন, পাতে একটু ধনেপাতার ভর্তা হলেই তাঁদের ভরপেট ভাত খাওয়া হয়ে যায়।
গ্রামবাংলার অনেক বাড়িতে ধনেপাতার চাষ করে মূলত পরিবারের চাহিদা মেটানো হয়। তবে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সাড়াই ইউনিয়নের ভেতরকুটি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় ধনেপাতার। ১৬ বছর আগে তৈয়ব আলীর (৬০) হাত ধরে সূচনা হয় এ চাষের। তাঁর সাফল্য দেখে গ্রামের অন্যরাও চাষে লেগে পড়েন। এখন গ্রামের মাঠের পর মাঠ ধনেপাতার চাষ হয়। যাঁদের জমি নেই, তাঁরা বর্গা নিয়ে চাষ করেন।
অথচ একসময় এ গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিলেন অভাবী। উঁচু এলাকা বলে ধানসহ অন্যান্য ফসল এখানে ভালো হতো না। খাবারও জুটত না অনেকের। তবে এখন দিন বদলেছে। ভেতরকুটির মানুষ ধনেপাতা চাষ করে ভালো করেছেন আর্থিক অবস্থা। এই গ্রামের সবাই বেশ সচ্ছল, সুখী জীবন।
এক দিন সেই গ্রামে: কাউনিয়া উপজেলার সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে ভেতরকুটি গ্রাম। লোকসংখ্যা হাজার দেড়েক।
কাঁচা-পাকা পথ ধরে গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মাঠজুড়ে অসংখ্য ধনেপাতার খেত। বেশির ভাগ বাড়িতে চকচক করছে টিনের চাল। আধাপাকা বাড়িও আছে কয়েকটি। কোথাও শণ বা খড়ের কুঁড়েঘর দেখা গেল না। তৈয়ব আলীর বাড়ি খোঁজ করতেই একজন দেখিয়ে দেন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, তৈয়ব ধনেপাতা তুলছেন, সঙ্গে পুত্রবধূরাও।
সংগ্রাম: ১৯৫১ সালে অভাবের সংসারে জন্ম তৈয়ব আলীর। লেখাপড়া করা হয়নি। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি বড়। ১০ বছর বয়সে মারা যান বাবা। ১১ বছর বয়সে হারান মাকে। ১৩ বছর বয়সে ধরেন সংসারের হাল।
বাড়িতে ধান সিদ্ধ করে চাল তৈরির পর তা বাজারে বেচার কাজ শুরু করেন তৈয়ব। কয়েক বছর চালের ব্যবসা করেন, কিন্তু অভাব পিছু ছাড়ে না। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে চালের ব্যবসা ছেড়ে দেন। কয়েক মাস বেকার ঘুরে বেড়ানোর পর গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের পরামর্শে শুরু করেন কাঁচা তরকারির ব্যবসা। ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে খেত থেকে করলা কিনতে পাশের নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী গ্রামে যান। সেখানে নাজমুল নামের একজনের কাছে ধনেপাতা চাষ করে ভাগ্য বদলানোর গল্প শোনেন। বিষয়টি তাঁর মনে ধরে। ঠিক করেন, ধনেপাতা চাষ করে অভাব জয় করবেন।
ওই বছরের নভেম্বরে ১০ শতক জমিতে তিনি ধনেপাতার চাষ করেন। ৩০ দিনে এ ধনেপাতা বেচে খরচ বাদে চার হাজার টাকা আয়ও হয়। পরের বছর ৪০ শতকে দুই দফায় ৭০ দিনে চাষ করে আয় করেন ৩০ হাজার টাকা। এরপর পুরোপুরি লেগে পড়েন। স্ত্রী-পুত্ররাও তৈয়ব আলীর সঙ্গে হাত লাগান। সংসারে আসে সচ্ছলতা।
ধনেপাতার চাষের টাকায় কেনেন তিন একর জমি, বানান পাকা বাড়ি। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তিন ছেলে ধনেপাতা আর নানা সবজি চাষে লেগে আছেন। এবার দেড় একর জমিতে ধনেপাতার চাষ করে এক লাখ টাকা আয় করেছেন।
ভাগ্য বদলাল যাঁরা: ভেতরকুটি গ্রামের আবুল কালাম সংসার চালাতে কখনো দিনমজুরি, কখনো বা রিকশা চালাতেন। এর পরও আট সদস্যের পরিবারে অভাব লেগে থাকত। তৈয়ব আলীর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি অন্যের ১৫ শতক জমি বর্গা নেন।
শুরু করেন ধনেপাতার চাষ। বদলে যায় ভাগ্যের চাকা। ধনেপাতা বেচার টাকায় কেনেন দেড় একর জমি। বানান পাকা বাড়ি। এবার ৮০ শতকে ধনেপাতার চাষ করে আয় করেছেন ৫২ হাজার টাকা।
গ্রামের মোসলেমার স্বামী ২০ শতক বসতভিটা আর দুই সন্তান রেখে ১২ বছর আগে মারা যান। অসহায় মোসলেমা শুরু করেন দিনমজুরি। এ কষ্ট দেখে তৈয়ব আলী পরামর্শ দেন ধনেপাতা চাষের। তৈয়বের কাছ থেকে বীজ নিয়ে মোসলেমা বসতভিটার চারদিকে ধনেপাতা চাষ করেন।
৩০ দিনের মধ্যে এ ধনেপাতা বেচে আয় হয় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। পরের বছর অন্যের ২০ শতক জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। এবার ৭০ শতক জমিতে এ ফসলের চাষ করেছেন। সন্তানদের নিয়ে বেশ ভালো আছেন।
গ্রামের আবদুল হালিম, ফিরোজা বেগম, মঞ্জিলা খাতুন, মোর্শেদা বেগম, সাহেদা খাতুন, জহরা বেগম, লাল মিয়াসহ অনেকেই ধনেপাতা চাষ করে ভাগ্য বদলের গল্প শোনালেন।
লাভ অনেক: গ্রামের কৃষক মোবারক হোসেন বলেন, ধনেপাতা চাষে পরিশ্রম কম। চারবার লাঙলের হাল দিয়ে চাষ করে একরে ৭০ কেজি ধনেপাতার বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। বীজ বপনের ২০ দিনের মাথায় হালকা একটা সেচ দিতে হয়। সার, কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। লাগে না তেমন পরিচর্যাও। ৩০ দিন পর খেত থেকে ধনেপাতা তুলে ওই জমিতে আবারও ধনেপাতা চাষ করা যায়।
কাউনিয়া উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুভলচন্দ্র বর্মণ বলেন, ধনেপাতার চাষ খুবই লাভজনক। এক একর জমিতে ধনেপাতা চাষ করতে বীজ-গোবর-চাষাবাদ বাবদ নয় থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। শুরুতে ১০০ টাকা এবং শেষে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও একরপ্রতি ৬০ হাজার টাকা আয় হয়, যা অন্য কোনো ফসল থেকে এত কম সময়ে আয় করা যায় না।
ধূমেরকুটি গ্রামের ধনেপাতার পাইকারি ব্যবসায়ী লাল মিয়া ও আবু বকর জানান, তাঁরা খেত থেকে ধনেপাতা কেনেন। এরপর হকের বাজার, মায়ার বাজার, খানসামা বাজার, কাউনিয়া বাজার, মেরাজের বাজারে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।
অন্যদের কথা: সাড়াই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, এক যুগ আগেও ভেতরকুটি গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। উঁচু এ এলাকায় ফসলাদি ভালো হতো না। এখন ধনেপাতাসহ নানান সবজি চাষ করে গ্রামবাসী অভাবকে জয় করেছেন। এ গ্রামের মানুষের সাফল্য দেখে পাশের বাইরাকুটি, সোনাতলা, কদমতলা, বালাপাড়া, বিশ্বনাথ চরে কৃষকেরা এসব ফসলের চাষ করছেন।
কাউনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, ভেতরকুটি গ্রামে ১৪-১৫ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে ধনেপাতার চাষ হচ্ছে। গ্রামের অন্তত ৭০ শতাংশ লোক এ চাষের সঙ্গে জড়িত। পুরো উপজেলায় প্রায় ৭২০ একর জমিতে ধনেপাতার চাষ হয়। prothom-alo

Friday, December 2, 2011

জয়তু সুবর্ণা আপা!

নিজের বাড়ির উঠানে হাতপাখা ও টুপিতে নকশার কাজে তদারক করছেন পীরগাছার ইটাকুমারী গ্রামের সুবর্ণা আ� নিজের বাড়ির উঠানে হাতপাখা ও টুপিতে নকশার কাজে তদারক করছেন পীরগাছার ইটাকুমারী গ্রামের সুবর্ণা আক্তার
ছবি: প্রথম আলো
‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করছেন তাঁরা। তাঁদের হারতে হয়নি, তাঁরা জিতে চলেছেন। স্বাবলম্বী হয়েছেন, অন্যদের এগিয়ে নিচ্ছেন সেই পথে।
বলা হচ্ছে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী গ্রামের নারীদের কথা। ‘গ্রামীণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি’ নামে সমবায় সমিতি গড়ে বদলে ফেলেছেন নিজেদের ভাগ্য। আর এই সমিতি গড়তে গ্রামের নারীদের এক সুতোয় গেঁথেছেন একজন—সুবর্ণা আক্তার। সদস্যদের কাছে তিনি কেবলই ‘সুবর্ণা আপা’।
সুবর্ণার নেতৃত্বে ওই সমিতির সদস্যরা হাতপাখা, লেপ, টুপিতে নকশা তোলা, মাছ, সবজি ও লিচু চাষ করে ইটাকুমারীকে কর্মমুখর এক গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
শুরুর গল্প: পীরগাছা উপজেলা সদর থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণের গ্রাম ইটাকুমারী। এক দশক আগেও এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ছিল দিনমজুর।
এই গ্রামেরই সচ্ছল এক পরিবারের মেয়ে সুবর্ণা। খুব কাছ থেকে দেখা গ্রামের মানুষের এমন কষ্ট তাঁকে নাড়া দিত। কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করতেন। সেই ভাবনা থেকে তাঁর মাথায় আসে সমবায় সমিতি গড়ার কথা। বিষয়টি গ্রামের নারীদের বোঝাতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর ডাকে সাড়া দেন নারীরাও।
সাফল্যের পথে: ২০০২ সালের ১০ জানুয়ারি। সুবর্ণা ১৪০ জন দরিদ্র নারীকে নিয়ে গঠন করেন গ্রামীণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি। সিদ্ধান্ত হয়, সদস্যরা সপ্তাহে পাঁচ টাকা করে সমিতিতে জমা দেবেন। চার বছরে সমিতির সঞ্চয় আর তা বিনিয়োগ করে পাওয়া লাভে তহবিলে জমা হয় তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা। সদস্যরা তা ভাগ করে নেন।
২০০৫ সালে সমিতির সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে ৩৫০ করা হয়। সাপ্তাহিক চাঁদা বাড়িয়ে করা হয় ১০ টাকা। দুই বছরে সদস্যদের জমা এবং তা বিনিয়োগে পাওয়া যায় তিন লাখ ৬৪ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে ২০০৭ সালে তিন একর আয়তনের একটি পুকুর ও দুই একর ফসলি জমি ইজারা নেওয়া হয় সমিতির নামে। পুকুরে মাছ ও জমিতে সবজি চাষ করে এক বছরে খরচ বাদে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা আয় হয়। মূলধন সমিতির তহবিলে রেখে লাভের অংশ সদস্যরা ভাগ করে নেন।
এগিয়ে চলা: সুবর্ণার চাওয়া ছিল, গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করবেন। তাই সমিতির লাভের অংশ ভাগ করে দিয়ে চুপ থাকেননি। প্রতিবেশীদের কাছে গল্প শুনে ২০০৮ সালের শুরুতে তিনি পাশের কামদেব গ্রামের রওশন আরা বেগমের কাছে যান। তাঁর কাছ থেকে শিখে নেন হাতপাখা তৈরির কৌশল। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে সমিতির সদস্যদের হাতপাখা তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। সমিতির তহবিল থেকে পোশাক কারখানার পরিত্যক্ত রঙিন সুতা কিনে শুরু হয় হাতপাখা তৈরি ও বিক্রির কাজ।
ওই বছরের জুন মাসে সমিতির নারীরা শুরু করেন টুপিতে নকশা তোলার কাজ। এর পর থেকে সমিতির সদস্য ছাড়াও আড়াই শতাধিক নারী হাতপাখা তৈরি ও টুপিতে নকশার কাজ করছেন। পাশাপাশি অনেকে লেপ-তোষক তৈরির কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন।
গৃহবধূ ছালেহা বেগম ও নাজমা আকতার জানালেন, একটি পাখা তৈরিতে ছয় থেকে সাত টাকা খরচ হয়, বিক্রি হয় ১৮ থেকে ২০ টাকায়। তাঁদের নকশা করা টুপি রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যে। একটি লেপ তৈরি করে ২০০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়।
সমিতিতে এক দিন: সম্প্রতি এক সকালে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সব বাড়িতেই নারীরা কেউ হাতপাখা, কেউ লেপ তৈরি, কেউ বা টুপিতে নকশা তোলার কাজ করছেন। সুবর্ণার বাড়িতেই একটি ঘর সমিতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহূত হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সুবর্ণা নারীদের নিয়ে সমিতির বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছেন।
সুবর্ণা জানালেন, সমিতির অধীনে মাছ-সবজির চাষ চলছে। চলছে হাতপাখা, লেপ তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা। ৫০ শতক আয়তনের একটি লিচুবাগান ইজারা নেওয়া হয়েছে। এসব উ ৎস থেকে আয় হওয়া অর্থ শুধু সমিতির সদস্যরাই ভাগ করে নেন না, আয়ের ৫ শতাংশ গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েদের বিয়েতে ব্যয় করা হয়। অভাবী শিক্ষার্থীদের কিনে দেওয়া হয় বই-খাতা। এ ছাড়া সমিতির উদ্যোগে নিরক্ষর গৃহবধূদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিচর্যা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, যৌতুক ও বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করা হয়।
সফল যাঁরা: সমিতির সদস্য আরজিনা খাতুন, খালেদা আকতারসহ কয়েকজন তাঁদের দিনবদলের গল্প শোনালেন। তাঁদের টিনের ঘর উঠেছে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। নিজেদের হাঁস, মুরগি, গাভি, ছাগল আছে। সর্বোপরি সংসারে তাঁদের মতামত গুরুত্ব পাচ্ছে।
হাছনা বেওয়া জানালেন, ১৫ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। এরপর ভিক্ষা করে সংসার চালাতেন। তবে এখন তাঁর হাঁস-মুরগি ও একটি গাভি আছে। ভিক্ষা ছেড়েছেন অনেক আগেই। এ সবই হয়েছে সমিতির সদস্য হয়ে।
২০০০ সালে এই গ্রামের চায়না বেগমের বিয়ে হয় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ী গ্রামে। যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় তিন বছরের মাথায় এক সন্তানসহ তাঁকে বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে হয়। তিনি এই সমিতির সদস্য হয়ে এখন মাসে প্রায় চার হাজার টাকা আয় করছেন।
এ ছাড়া গ্রামের লাকী বেগম, সহিদা বেগম, মঞ্জুয়ারা খাতুন, আছমা বেগম, মাজেদা খাতুনসহ অনেকের কাছেই শোনা গেল তাঁদের অভাব জয়ের গল্প।
একজন সুবর্ণা: স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত নারী সদস্য গুলশান আরা বেগমের ছোট মেয়ে সুবর্ণা। বিএ পাস সুবর্ণার বিয়ে হয় একই গ্রামের আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে। তাঁদের সাড়ে তিন বছরের একটি ছেলে আছে। স্ত্রীর উদ্যোগের প্রতি সম্মান আছে স্বামী আশরাফুজ্জামানের। ‘সুবর্ণার কর্মকাণ্ডে আমরা খুশি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে সব সময় সমিতির কাজে উ ৎসাহ দিই।’ বলছিলেন তিনি।
ইটাকুমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান দছিজল হক বলেন, সুবর্ণার মতো নারীই এই সমাজে প্রয়োজন। ইটাকুমারী গ্রামে বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কমেছে যৌতুকের প্রবণতাও। স্বাস্থ্যসচেতনতা, শিক্ষার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে।
যেতে চান অনেক দূর: গ্রামের নারীদের জন্য আর কী করতে চান? সুবর্ণার উত্তর, ‘প্রত্যেক সদস্যকে একটি করে বিদেশি গাভির খামার করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। হাতপাখা, লেপ তৈরি ও টুপিতে নকশার কাজে পুরো উপজেলার দরিদ্র নারীদের যুক্ত করার বিষয়টিও মাথায় আছে।’
সুবর্ণা জানালেন, তাঁর স্বপ্ন—উপজেলার প্রতিটি নারী মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন। এ জন্য নারীদের সংগঠিত করে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার আওতায় এনে বাল্যবিবাহ, যৌতুকের কুফল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে চান তিনি।
সফল হোক তাঁর এই যাত্রা!

Friday, October 21, 2011

 নিপীড়িত মানুষের প্রেরণা

  • ইলা মিত্র (জন্ম: ১৯২৫—মৃত্যু: ২০০২) ইলা মিত্র 
 কলকাতায় আন্দোলনের সময় বন্দী ইলা মিত্র
কলকাতায় আন্দোলনের সময় বন্দী ইলা মিত্র
মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ইলা মিত্র কিংবদন্তিসম এক নাম। তাঁর যুগে শ্রমের ফসল কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে যা ছিল বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, আজ তা হয়েছে জাতিসত্তার পরিচয় কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে অন্তহীন সংগ্রাম। গত ১৮ অক্টোবর ছিল মহীয়সী এই নারীর জন্মদিন।

ইলা মিত্র (১৯২৫-২০০২) নিত্যস্মরণীয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্র। সংগ্রামী মানুষের আন্দোলনের ইতিহাসে দেশ-কাল-ধর্ম-জাতি-শ্রেণী-লিঙ্গ তুচ্ছ করা অনমনীয় মৃত্যুহীন প্রাণ ইলা মিত্র। তাঁর ইতি নেই। অন্তহীন তাঁর ইতিহাস, ইতিবৃত্ত ও ইতিকথা। আজও তাঁর নাম, তাঁর সংগ্রামের প্রেরণা নাচোলের অধিকারহারা সাঁওতাল জনগণের প্রাণে সাড়া জাগায়। আজও বাংলাদেশের সংগ্রামী অধিকারহারা যেকোনো স্তরের এবং শ্রেণীর মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার শক্তি সঞ্চয় করার জন্য ইলা মিত্রের সংগ্রাম থেকে পাঠ নেয়।

১৯৪৫ থেকে ১৯৫৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ছিলেন—মাঠে-প্রান্তরে-সংগ্রামে এবং জেলে বন্দী অবস্থায়। নাচোলের তেভাগা আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা সে সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে হলেও ব্যক্তি ইলা মিত্রের সংগ্রামী চেতনার বিদ্রোহ অগ্নস্ফুিলিঙ্গের মতো উদ্দীপ্ত করেছিল সেই আন্দোলনের অধিকারহারা সাঁওতাল কৃষক নারী-পুরুষের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে।
১৯৪৮-এ শুরু হয়ে ১৯৫০ সালের প্রথম কাল পর্যন্ত নাচোলে তেভাগা আন্দোলন বা কৃষক বিদ্রোহ উত্তুঙ্গে উঠেছিল। সাঁওতাল এই কৃষকদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ভারত উপমহাদেশের সাঁওতাল পরগনা জেলার অধিবাসী। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সাঁওতাল আদিবাসীরা মহাবিদ্রোহের হুংকার তুলেছিলেন। সেই বিদ্রোহীরা এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের সাঁওতাল অধিবাসীরা নিজ বাসভূমে শান্তিতে বাস করতে পারেননি—হয়েছিলেন শোষিত, নির্যাতিত, জীবিকাবঞ্চিত দরিদ্র, নিঃশেষিত। এঁরা ছিলেন বর্গাচাষি। বর্গাচাষিদের শ্রমের ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ কেড়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে জোতদারেরা কৃষকের ন্যায্য অধিকারের ওপর আঘাত করলেন। কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক সাঁওতালদের সংগঠিত করে নাচোলের তেভাগা আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের পর সে সময় দেশের অন্যান্য স্থানের তেভাগা আন্দোলনের নতুন জাগরণ ঘটেনি—শেষ হয়ে গিয়েছিল তেভাগা আন্দোলনের কর্মকাণ্ড। হঠাৎ করেই নতুন পর্যায়ের তেভাগা আন্দোলন শুরু হলো নাচোলে।
নাচোল থানার চণ্ডীপুর গ্রামের সাঁওতাল নেতা মাতলা সরদার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। সেই এলাকার কমিউনিস্ট রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, অনিমেষ লাহিড়ী, শিবু কোড়ামুদি, বৃন্দাবন সাহা, আজহার হোসেন, চিত্ত চক্রবর্তী আত্মগোপনে থেকে সাঁওতালদের সংগঠিত করেছেন, এলাকার অন্যান্য হিন্দু-মুসলিম ধর্মনির্বিশেষে সব কৃষক সংগঠিত হয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে।
পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ-কর্তৃত্ব নাচোলের সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে কৃষক সমিতির নেতারা আহ্বান জানালেন আমন ধান কেটে তিন ভাগের দুই ভাগ ধান নিজেদের গোলায় তোলার জন্য। সে সময়ে পার্টির নেতা রণদীভের তত্ত্ব এবং নির্দেশিত সিদ্ধান্তে হঠকারীভাবে, অপ্রস্তুত পদ্ধতিতে নাচোলে কৃষক বিপ্লব ও পুলিশ-কৃষক সংঘর্ষ ঘটল এই ধান কাটা ও তিন ভাগের দুই ভাগ কৃষকের গোলায় তুলে নেওয়ার আন্দোলনের ফলে।
এ অবস্থায় পুলিশি আক্রমণের সময় ইলা মিত্র ছদ্মবেশে আত্মগোপনে যাওয়ার পথে ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি পুলিশের হাতে বন্দী হন রহনপুর স্টেশনে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত জেল-জুলুম আর শারীরিক-মানসিকভাবে পুলিশি সন্ত্রাস ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
১৯৫০-৫৪ পর্যন্ত তাঁর মুক্তির দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠায় পাকিস্তান সরকার।

 
ইলা মিত্রের সংগ্রাম সে সময় থেমে যায়নি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তিনি আজীবন রাজনৈতিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে নিবেদিত ছিলেন। একসময়ের ক্রীড়াবিদ ইলা সেন, বেথুন কলেজের ছাত্রী ইলা সেন। বিদ্রোহে-বিপ্লবে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠেছিলেন ইলা মিত্র। তাঁর জীবন ছিল কর্মময়। অধ্যাপনার পেশায় তিনি যেমন ছিলেন কর্মনিষ্ঠ, তেমনি নিবেদিত ছিলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। মানুষের কল্যাণ সাধনায় ছিলেন তিনি সক্রিয় মানবতাবাদী।
তাঁর সংগ্রামী জীবনের নানা দিকের আলোকপাতে আমরা জানি তিনি কখনোই অতিমানব হয়ে ওঠার আগ্রহ পোষণ করেননি; বরং সেই ধরনের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর সংগ্রাম ছিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ‘রাষ্ট্র বনাম অধিকারহারা মানুষের সংগ্রাম’। এই সংগ্রামের উত্তরাধিকারীদের কাছে তিনি দিয়ে গেছেন তাঁর এবং আরও সব বিপ্লবী-সংগ্রামীর অসমাপ্ত কাজ। সেই সংগ্রামের সূত্র ধরেই ইলা মিত্র আজও প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক এবং যুদ্ধ-সন্ত্রাসের শিকার করা হয়েছিল ইলা মিত্রকে। ‘নারীর বিদ্রোহ’ বলে ভাবা হয়েছিল তাঁর সংগ্রামকে। তাই তাঁর শরীরের ওপর নির্যাতনের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বীভৎস কদর্যরূপে নিজেদের কলঙ্ক লেপন করতে চেয়েছিল। পারেনি ইলা মিত্রের মনোবল ভেঙে দিতে। তাঁর পাশে এ দেশের অগণিত মানুষ দাঁড়িয়েছিল। নিপীড়িত মানুষ নিজেদের শিকল ছিঁড়েছে তাঁর বন্দিত্বের শিকল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে।
ইলা মিত্র জন্ম নিয়েছিলেন ১৮ অক্টোবর ১৯২৫ সালে। তাঁর জীবনাবসান হয়েছে ১৩ অক্টোবর ২০০২ সালে। ৭৭ বছরের সংগ্রামী, প্রাণস্ফূর্ত ইলা মিত্র দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। তাঁর স্মরণে ইতিহাসের মর্মবাণী গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে নিপীড়িত সাঁওতালসহ প্রান্তিক, দলিত, অধিকারহারা আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রূপান্তরিত হয়েছে সাঁওতাল-প্রান্তিক আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ পরিচয় বাংলাদেশের সংবিধানে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে। এমনকি সম্প্রতি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও তাদের আদিবাসী পরিচয়ের স্বীকৃতি মেলেনি।
ইলা মিত্রের সংগ্রামের যুগে যা ছিল ‘শ্রমের ফসল কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে’ বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, আজ তা হয়েছে ‘জাতিসত্তার পরিচয় কেড়ে নেওয়ার’ বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার অন্তহীন সংগ্রাম। এই সংগ্রামের সঙ্গে ঐতিহাসিক পরম্পরায় ইলা মিত্র সম্পৃক্ত হয়ে আছেন; থাকবেন যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত-অধিকারহারা মানুষের সংগ্রামের প্রেরণারূপে। প্রথম আলো

Saturday, October 1, 2011

স্বপ্ন পূরণের সারথি

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্লাস নিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী একজন শিক্ষক সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্লাস নিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী একজন শিক্ষক
ছবি: প্রথম আলো
অভাবের সংসারে ইরফানের জন্ম। একদিন বাবা মারা গেলেন। ইরফান তখন মাত্র সপ্তম শ্রেণীতে। থমকে দাঁড়াল লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। সংসারের হাল ধরতে ওই বয়সেই কাজ নিতে হলো পাটকলে।
তবে ইরফানের স্বপ্ন থমকে দাঁড়াতে দেয়নি ‘বঞ্চিতদের জন্য শিক্ষা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মানুষ হওয়ার স্বপ্নের জাল বুনছেন।
শুধু ইরফান নন, তাঁর মতো অন্তত ৪০০ শিক্ষার্থী ‘বঞ্চিতদের জন্য শিক্ষা’র সহায়তায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখছে। তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সারথি একজন হাফিজুর রহমান। তিনিই গড়ে তুলেছেন বিনা পয়সার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘বঞ্চিতদের জন্য শিক্ষা’। নরওয়ে প্রবাসী হাফিজুরের বাড়ি খুলনা মহানগরের ফুলবাড়ী গেটে। নগরের যোগীপোল এলাকায় চলছে তাঁর এ শিক্ষা কার্যক্রম।
যেভাবে শুরু: স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কথা ভাবতেন হাফিজুর রহমান। স্বপ্ন দেখতেন, একটি দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষিত সমাজের। সেই স্বপ্নের কাজ শুরু করেন নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন। তখন থেকেই বাড়ির পাশের বস্তির শিশুদের বাড়িতে এনে বিনা পয়সায় পড়াতেন। পুরো ছাত্রজীবনে এটা চালিয়ে যান। ২০০৫ সালে সাতটি শিশুকে বই-খাতা কিনে দিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন তিনি। একই বছর উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে নরওয়ে চলে যান। তবে সেখানে গিয়েও ওই সব শিশুর কথা ভোলেননি। ওদের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দেন ভাগনে আল আমিনকে।
আল আমিন নিজের বাড়ির একটি কক্ষে মাদুর বিছিয়েই ওদের পড়াতেন। মামা-ভাগনের এই উদ্যোগের কথা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বিষয়টি মামাকে জানান আল আমিন। মামা নরওয়ে থেকে তাঁর বৃত্তির অর্থ থেকে একটি অংশ পাঠিয়ে দেন। সেই অর্থ দিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য চারটি বেঞ্চ, একটি ব্ল্যাকবোর্ড ও কিছু বই-খাতা কেনেন আল আমিন। চালিয়ে যান সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানোর কাজ।
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ: হাফিজুর রহমানের এই উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০০৮ সালে গঠিত হয় ‘বঞ্চিতদের জন্য শিক্ষা’ (এডুকেশন ফর ডিপ্রাইভ স্টুডেন্ট), সংক্ষেপে ইডিএস। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন হাফিজুরের বৃত্তি থেকে পাঠানো অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে নরওয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পান হাফিজুর। তাঁর বেতন থেকে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা করে পাঠানো শুরু করেন। ওই বছর প্রতিষ্ঠানের জন্য আট লাখ টাকা দিয়ে নগরের যোগীপোল এলাকায় একটি একতলা ভবন কেনা হয়। পরের বছর ওই ভবনে পড়ানোর কাজ শুরু করেন আল আমিন। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। অনেকেই স্বেচ্ছাশ্রমে পড়ানো শুরু করেন।
শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়ায় ওই ভবনেও জায়গা হচ্ছিল না। তাই ভবনের পাশের গোলপাতার ছাউনির একটি ঘর ভাড়া নেওয়া হয়। এখানে সকাল ও বিকেলে পালা করে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ২০০ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা চলছে।
কিন্তু শিক্ষার্থী আরও বাড়তে থাকায় সোনালী জুটমিল মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও অ্যাজাক্স জুটমিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই পালায় আরও ২০০ শিক্ষার্থীকে পড়ানো হচ্ছে।
সাড়া: নগরের মহেশ্বরপাশা, কার্তিককুল, তেলিগাতি, খানাবাড়ী, জাবদিপুর, যোগীপোল, বণিকপাড়া, মানিকতলা, কালীবাড়ি, সেনপাড়া ও ফুলবাড়ী গেটসহ বিভিন্ন এলাকার হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের পরিবারের সন্তানেরা এখানে পড়ছে। অভাবী পরিবারের যে শিশুরা ভিক্ষা, দিনমজুরি বা চুরিতে জড়িয়ে পড়েছিল, হাফিজুরের প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এখন তারা বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিনোদন, খেলাধুলা ও বনভোজনেরও ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। ভালো ফলের জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে পুরস্কার।
এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা অনেকেই ভালো ফল করছে। চলতি বছর এখানে পড়াশোনা করেছেন এমন ১২ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দেন। সবাই পাস করেছেন। একজন জিপিএ ৫ পেয়েছেন। যাঁদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তাঁরাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ের ফিও দিচ্ছেন হাফিজুর।
শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবক: আটজন শিক্ষককে বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে। সঙ্গে রয়েছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী। তাঁরা স্বেচ্ছাশ্রমে পড়াচ্ছেন। সঙ্গে আছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মতিউল ইসলাম ও খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বিষ্ণু সরকার।
স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সেলিম রেজা বলেন, ‘হাফিজুর রহমানের এমন মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত।’
ওদের কথা: নগরের ফুলবাড়ী গেটের হোটেল কর্মচারী আবদুর রাজ্জাকের মেয়ে মারিয়া বেগম। তৃতীয় শ্রেণীতে ওঠার পরই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় তার। হাফিজুরের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয় তাকে। এখন সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। ‘হাফিজুর ভাই না হলে ক্লাস এইটে ওঠা হতো না।’ জানাল, মারিয়া।
ভ্যানচালক আবুল গাজীর মেয়ে জান্নাতুল আখতার। পঞ্চম শ্রেণীর পর সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছিল না। এখন সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। জান্নাতুল বলে, ‘হাফিজুর ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানে বিনা পয়সায় পড়ছি। এখন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখছি।’
নরসুন্দর বিষ্ণুপদ সরকারের ছেলে গৌরাঙ্গ সরকার অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। ছেলেকে ওই প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর প্রসঙ্গ তুললে বিষ্ণুপদের উত্তর, ‘প্রাইভেট পড়াতে না পারায় ছেলে পড়াশোনায় ভালো করছিল না। ওখানে পাঠানোর পর ভালো করছে।’
তাঁরা যা বলেন: প্রায় শুরু থেকেই হাফিজুর রহমানের উদ্যোগের সঙ্গে আছেন আল আমিন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ‘মামার এই উদ্যোগে সহায়তা করতে পেরে আমি গর্বিত। তাঁর মতো মানুষ আমাদের সমাজের দৃষ্টান্ত।’ বলেন, আল আমিন।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান কে এম আজহারুল জানান, তিনি কয়েকবার ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘এটা ভালো উদ্যোগ। এতে উৎসাহ দিতে আমার বিভাগের শিক্ষার্থীদের ওখানে স্বেচ্ছাশ্রমে ক্লাস নিতে উদ্বুদ্ধ করেছি। অনেকে ক্লাসও নিচ্ছে।’
মুঠোফোনে কথা হয় হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান তাঁর স্বপ্নের কথা। ‘এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সবাই সবাইকে সহযোগিতা করবে। দেশ ও জনগণ এগিয়ে যাবে। জানি কঠিন কাজ, তার পরও চেষ্টা থাকবে।’ বলে যান তিনি, ‘প্রতিষ্ঠানটি আমার প্রাণ। এটি আরও বড় করার ইচ্ছা আছে। আমার স্বপ্ন সেদিনই সার্থক হবে, যেদিন সুবিধাবঞ্চিত এই শিক্ষার্থীরা শিক্ষিত হয়ে সমাজে আলো জ্বালাবে

Friday, September 16, 2011

দীপ জ্বেলে যাই

পঞ্চগড় পৌরসভার তুলারডাঙ্গা গ্রামে জনির পাঠশালায় পাঠদান চলছে পঞ্চগড় পৌরসভার তুলারডাঙ্গা গ্রামে জনির পাঠশালায় পাঠদান চলছে
ছবি: প্রথম আলো
ছেলে অসুস্থ। ওষুধ খাওয়াতে হবে। আশপাশে কেউ নেই যে সাহায্য নেবেন। গ্রামের নিরক্ষর মা ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন। একপর্যায়ে ওষুধ মনে করে ঘরে থাকা কীটনাশক ছেলের মুখে তুলে দিলেন। যখন বুঝতে পারলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছেলে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
মর্মান্তিক এ ঘটনা প্রতিবেশী এক তরুণের মনে নাড়া দেয়। ওই তরুণ ভাবেন, ওই মা যদি লিখতে-পড়তে পারতেন, তবে হয়তো এমন ভুল করতেন না। এসব মানুষকে শিক্ষার আলো দেওয়ার ব্রত নেন তিনি। সেই ব্রত থেকেই গ্রামে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। গৃহশিক্ষকতা করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে যাত্রা শুরু সেই পাঠশালার, যেটি পরিচিতি পায় ‘জনির স্কুল’ নামে।
তরুণের নাম নজরুল ইসলাম জনি। পঞ্চগড় পৌরসভার তুলারডাঙ্গা গ্রামে তাঁর বাড়ি। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। এরপর ওই স্কুল নিয়েই ব্যস্ত।
শুরুর কথা: মন নাড়া দেওয়া ওই ঘটনাটি ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের। এ ছাড়া লেখাপড়া না জানায় গ্রামের সাধারণ মানুষের নানাভাবে প্রতারণার শিকার হওয়া, শিশু ও নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, মাদকের ছোবল তো আছেই। বিষয়টি ভাবায় জনিকে। তিনি চিন্তা করেন, শিক্ষাই এর সমাধান। এসব নিয়ে আলোচনা করেন সহপাঠী একই গ্রামের একরামুল হাসানের সঙ্গে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন পাঠশালা গড়বেন। দুই বন্ধু মিলে ঠিক করেন জনির বাড়ির পাশের সুপারির বাগানে গ্রামের নিরক্ষরদের পড়ানো হবে।
জনি ও একরামুল তাঁদের ইচ্ছার কথা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানান। নিরক্ষর নারী-পুরুষকে পড়তে আসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু নারীদের ঘর থেকে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁরা হাল ছাড়েননি। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে খোলা আকাশের নিচে শুরু হয় লেখাপড়া। প্রথমদিকে সেখানে পড়তে আসত মাত্র ১৮ থেকে ২০ জন। দুটি পালায় পড়ানো শুরু হয়। বিকেলে পড়েন নারীরা, রাতে পুুরুষেরা। জনির প্রাইভেট পড়ানোর টাকায় কেনা তিনটি হারিকেন ও পাঁচ লিটার কেরোসিন তেল দিয়ে শুরু হয় রাতের পড়া।
দিনের পালায় পড়ানো ভালোমতো চললেও রাতের পালায় সমস্যা হতো। কারণ, কেরোসিন কেনার খরচ কম নয়। একপর্যায়ে একরামুলের সহায়তা আর পান না জনি।
জনির হার না মানা মানসিকতা দেখে এগিয়ে আসেন গ্রামের দিনার চৌধুরী। দুজনে মিলে স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের বই, খাতা-কলম, চক-ডাস্টার, বসার চট, মোমবাতি-হারিকেনসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করেন। তার পরও যেন এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছিল না। জনির উদ্যোগের কথা জানতে পেরে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা এগিয়ে আসেন।
জনির বাড়ির উঠানে টিনের চালা করে বানানো হয় পাঠশালা। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বর্তমানে তিন পালায় চলছে পাঠদান। দুপুরের পালায় পড়ানো হয় শিশুদের। বর্তমানে এ পালায় সুবিধাবঞ্চিত ৩৬টি শিশু পড়াশোনা করছে। বিকেলের পালায় পড়ছেন ৩০ জন নারী। আর রাতের পালায় পড়েন ২৫ থেকে ৩০ জন পুরুষ। কাউকে বেতন দিতে হয় না।
পাঠশালার শিক্ষক বলতে জনি নিজেই। শিশুরা ছয় মাস এখানে পড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়। বয়সী নারী-পুরুষেরাও ছয় মাস এখানে পড়েন।
আরও কিছু: জনির পাঠশালায় লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রথা রোধ, ঝগড়া-বিবাদ নিষ্পত্তি, মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। বিপদে-আপদে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করা, সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলা, বাড়িতে ছোটখাটো খামার তৈরি, শাকসবজির বাগান, হাঁস-মুরগি-কবুতর, গরু-ছাগল পালনেও উদ্বুদ্ধ করা হয়।
একদিন পাঠশালায়: জনির পাঠশালায় ঢুকে দেখা গেল, দুই সারিতে বসে শিশুশিক্ষার্থীরা বই নিয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার জানাল, সে আগে স্কুলে যেতে পারেনি। এখন জনির স্কুলে এসে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক সব বিষয় পড়ছে।
কথা হলো বিকেলের পালায় পড়তে আসা গৃহবধূ আছিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বললেন, পড়তে না পারায় ওষুধ ভেবে ছেলেকে কীটনাশক খাইয়েছিলেন। সেই যন্ত্রণা এখনো ভোগ করছেন। এ স্কুলে এসে এখন পড়া ও লেখা দুটোই পারেন। ‘ছোটবেলায় পড়ালেখা করতে পারিনি। কম বয়সেই বিয়ে হয়। পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল। এখন এই স্কুলে এসে পড়াশোনা করছি।’ বলছিলেন গৃহবধূ মমতাজ বেগম। গৃহবধূ সহিদা বেগম বললেন, প্রথম প্রথম পড়তে আসতে লজ্জা লাগত। কিন্তু এখন ভালোই লাগছে।
সারা দিন খাটা-খাটুনির পর রাতের পালায় পড়তে আসেন মনজুর রহমান (৪০)। ‘পড়াশোনা না জানলে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এখন পড়তে ও লিখতে পারি।’ সরল উত্তর মনজুরের।
অন্যদের কথা: জনির সহযোগী দিনার বলেন, ‘জনির মহ ৎ উদ্যোগ আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই ওঁর সঙ্গে যোগ দিই। এই উদ্যোগে সহযোগিতা করতে পেরে ভালোই লাগছে।’
জনির বাবা আবদুস ছাত্তার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আবদুস ছাত্তার বলেন, এ কাজকে প্রথমদিকে ছেলের পাগলামি মনে হতো। এখন সবাই ছেলের প্রশংসা করে। খুব গর্ব হয়।
পঞ্চগড়-১ আসনের সাংসদ মো. মজাহারুল হক প্রধান এ উদ্যোগের প্রশংসা করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এমন উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। একই কথা বলেন পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র তৌহিদুল ইসলাম। তিনি স্কুলের উন্নয়নে সহযোগিতাও করেছেন।
জনির ইচ্ছা: এরই মধ্যে কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন জনি। সাক্ষরতাদানে বিশেষ অবদান রাখায় ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে জেলা প্রশাসন জনিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সম্মাননা সনদ’ দিয়েছে।
জনি বলেন, ‘ইচ্ছা আছে পাঠশালার জন্য একটি পাকা ঘর তৈরি করার। সেখানে বিদ্যু ৎ, পানীয় জল এবং শৌচাগার থাকবে। এ ছাড়া সুযোগ পেলে এ এলাকার প্রতিটি গ্রামে এমন একটি করে পাঠশালা গড়ে তুলব।

Wednesday, September 14, 2011

 কিলিমানজারো জয় করলেন মুসা ইব্রাহীম ও নিয়াজ

কিলিমানজারোর উহুরু পিক-এ বাংলাদেশের পতাকা হাতে (বাঁ থেকে) নিয়াজ মোরশেদ পাটওয়ারী ও মুসা ইব্রাহীম: কিলিমানজারোর উহুরু পিক-এ বাংলাদেশের পতাকা হাতে (বাঁ থেকে) নিয়াজ মোরশেদ পাটওয়ারী ও মুসা ইব্রাহীম: ছবিটি ই-মেইলে পাঠিয়েছেন মুসা ইব্রাহীম
বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীম এবার জয় করলেন আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট কিলিমানজারো। নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশের (এনএসিবি) এই অভিযানে মুসার সঙ্গে এ পর্বতচূড়া জয় করেছেন নিয়াজ মোরশেদ পাটওয়ারী। কিলিমানজারো জয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের (সেভেন সামিট) দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করল এনএসিবি।
মুসা ইব্রাহীম ই-মেইল বার্তায় জানান, ১২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় সকাল সাতটা ৪৮ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ১০টা ৪৮ মিনিট) কিলিমানজারো জয় করেন দুই বাংলাদেশি পর্বতারোহী। তানজানিয়ায় অবস্থিত ১৯ হাজার ৩৪০ ফুট উঁচু আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতে এদিন এনএসিবির সাধারণ সম্পাদক মুসা ইব্রাহীম ও সদস্য এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক নিয়াজ মোরশেদ পাটওয়ারী বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। এনএসিবির পক্ষ থেকে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।
জানা যায়, এই অভিযানে কিলিমানজারো পর্বতের মাচামি রুট অনুসরণ করা হয়। তবে এই অভিযানের অপর সদস্য ৫৭ বছর বয়সী এম এ সাত্তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১১ সেপ্টেম্বর ১৩ হাজার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট বারানকো ক্যাম্প থেকে মোশি শহরে ফিরে আসেন।
এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর এনএসিবির সদস্যরা ছয় হাজার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মাচামি গেট থেকে কিলিমানজারো পর্বতাভিযান শুরু করেছিলেন। এরপর মাচামি ক্যাম্প, শিরা ক্যাম্প ও বারানকো ক্যাম্প হয়ে তাঁরা ১১ সেপ্টেম্বর ১৫ হাজার ৮৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট সর্বশেষ ক্যাম্প বারাফুতে পৌঁছান। এখান থেকে অভিযাত্রীরা ১২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় রাত সোয়া একটায় পর্বতচূড়া জয়ের জন্য যাত্রা (সামিট পুশ) শুরু করেন। ছয় ঘণ্টা ৩৩ মিনিট আরোহণ শেষে তাঁরা কিলিমানজারোর সর্বোচ্চ পয়েন্ট ১৯ হাজার ৩৪০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট উহুরু পিকে পৌঁছে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। একই দিন তাঁরা ১০ হাজার ১৬৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মেওকা ক্যাম্পে নেমে আসেন।
এনএসিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, গতকাল মেওকা গেটে কিলিমানজারো ন্যাশনাল পার্ক ও তানজানিয়া ন্যাশনাল পার্ক কর্তৃপক্ষ তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে উহুরু পিক আরোহণ করার সনদ দেন। ২০ সেপ্টেম্বর তাঁরা দেশে ফিরবেন।
সামিট গ্রুপ, এমিরেটস এয়ারলাইনস, শাহ্ সিমেন্ট, জেএএন অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড ও ডেইলি স্টার এনএসিবির সেভেন সামিট অভিযানের কিলিমানজারো পর্বতাভিযান পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
কিলিমানজারো অভিযানের প্রাক্কালে মুসা ইব্রাহীমকে বাংলাদেশের পর্যটন দূত হিসেবে ঘোষণা দেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের। মুসা ইব্রাহীম ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করে সেভেন সামিটের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করেন।

Friday, September 2, 2011

মাহামুদা এখন সবার প্রিয়

হাতপাখা তৈরি করতে ব্যস্ত তারাগঞ্জ উপজেলার পাশারী পাড়া গ্রামের মাহমুদাসহ গ্রামের অন্য নারীরা হাতপাখা তৈরি করতে ব্যস্ত তারাগঞ্জ উপজেলার পাশারী পাড়া গ্রামের মাহমুদাসহ গ্রামের অন্য নারীরা
ছবি: প্রথম আলো
চতুর্থ শ্রেণীতে উঠে অভাবের কারণে স্কুল ছেড়েছিল মেয়েটি। ১৪ বছর বয়সে বাধ্য হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে বসতে। দিনমজুর স্বামীর সংসারে এসেও অভাব পিছু ছাড়েনি। জোটেনি ঠিকমতো দুইবেলা ভাতও। এরই মধ্যে মেয়েটি স্বপ্ন দেখেছে নিজে কিছু করার। একসময় শুরু করে হাতপাখা তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা। আসে সাফল্য। অভাবের সংসারে আসে সচ্ছলতা।
এই সংগ্রামী মানুষটির নাম মাহামুদা বেগম। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের পাশারীপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি।
হাতপাখা তৈরি করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাঁর দেখানো পথেই ওই গ্রামের অন্তত তিন শতাধিক গৃহবধূ দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। তালপাখা তৈরি করে বেশ কাটছে তাঁদের দিন।
মাহামুদা এখন গ্রামের সবার প্রিয়। তাঁর স্বামীর কথা, ‘অর জন্যে হামারা এলা সমাজোত মাথা উঁচা করি চলবার পারি।’
সংগ্রাম: তারাগঞ্জের হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের নদীরপার গ্রামে ১৯৬৫ সালে দরিদ্র পরিবারে জন্ম মাহামুদার। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবার অভাবের সংসার। ১৯৭৯ সালে বাবা মোবারক হোসেন কিশোরী মেয়েকে তুলে দেন পাশারীপাড়া গ্রামের খোয়াজ উদ্দিনের হাতে।
স্বামীর বাড়িতে এসেও সুখ হয়নি মাহামুদার। প্রায়ই অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হতো। কিন্তু এত অভাব, এত দরিদ্র তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাঁর কিশোরী মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। মুড়ি বানিয়ে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। এতে কিছু আয় হয়। এক বছরের লাভের টাকায় কেনেন চারটি ছাগল। তাঁর নতুন জীবনের গল্পটা এখান থেকে শুরু।
গল্পটা এ রকম: ১৯৯০ সালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা গ্রামের হাতপাখা বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম পাশারীপাড়া গ্রামে পাখা নিয়ে আসেন। মাহামুদা তাঁর কাছ থেকে দুটি পাখা কেনেন। হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি এলে তিনি মাহামুদার বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নেন। সারা দিনে ঝড়-বৃষ্টি না থামায় তাঁকে রাত যাপন করতে দেন মাহামুদার শ্বশুর আফজাল হোসেন। রাতে খাওয়ার সময় নানা কথার ফাঁকে রফিকুল মাহামুদাকে পাখা তৈরির পরামর্শ দেন। পরের দিন পাখা বিক্রি শেষে বিকেলে রফিকুল তাঁর বাড়িতে মাহামুদা ও তাঁর শ্বশুরকে নিয়ে যান। রফিকুলের স্ত্রী মমতাজ খাতুন মাহামুদাকে দুই দিনে শিখিয়ে দেন পাখা তৈরির কলাকৌশল।
বাড়ি ফিরে মাহামুদা তাঁর স্বামীকে তালপাতা সংগ্রহ করতে বললে তিনি এনে দেন। দুই দিনে মাহামুদা তৈরি করেন ২৫টি পাখা। এ পাখা বেঁচে আয় হয় ৮০ টাকা। খুলে যায় মাহামুদার চোখ। স্বামী-স্ত্রী লেগে পড়েন পাখা তৈরির কাজে। ভালো মুনাফা হওয়ায় বদলাতে থাকে সংসারের মলিন চেহারা।
তাঁর উন্নতি দেখে প্রতিবেশী অন্য নারীরা পাখা তৈরির কৌশল শিখতে আসেন। মাহামুদা তাঁদের শিখিয়ে দেন।
পাশারীপাড়া গ্রামের তিন শতাধিক গৃহবধূ ছাড়াও দামোদরপুর, ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের শতাধিক নারী এখন পাখা তৈরি করে বেশ আয় করছেন।
মাহামুদা পাখা বিক্রির টাকায় এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কিনেছেন আবাদি জমি। খড়ের ঘরের জায়গায় উঠেছে টিনের ঘর। বাড়িতে বসিয়েছেন নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। তিনটি গাভি, হাঁস-মুরগি ও ছাগল আছে। নলকূপের কিনারেই বানিয়েছেন ছোট্ট একটি পুকুর, তাতে চলছে হাঁস পালন ও মাছের চাষ। তাঁর দুই মেয়ে লেখাপড়া করছে। দুই ছেলে বিয়ের পর পাখার ব্যবসা করে আলাদাভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
মাহামুদার পথ ধরে: মাহামুদার পথ অনুসরণ করে যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের একজন লাইলী খাতুন। ১২ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। এখন প্রতি মাসে তাঁর গড়ে তিন হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
হাছিনা খাতুনের স্বামী মনোয়ার হোসেন জুয়া খেলতেন। হাছিনা সংসার চালাতেন ঝিয়ের কাজ করে। মাহামুদার পরামর্শে ১০ বছর আগে তিনি হাতপাখা তৈরি শুরু করেন। স্বামী জুয়া ছেড়ে এখন করেন পাখা বিক্রির ব্যবসা।
সোহাগী খাতুনের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। ভূমিহীন স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। তিন সন্তান নিয়ে প্রায়ই উপোস থাকতে হতো। এখন তাঁর পাখা তৈরির আয়ের টাকায় সংসার চলছে, স্বামীর আয় জমা থাকছে।
ওই পল্লিতে এক দিন: পাশারীপাড়া গ্রামের ৩০০টি পরিবারের কেউ পাখার কারিগর, কেউ ব্যবসায়ী। সম্প্রতি গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, কেউ পাখা বানাচ্ছে, কেউ তালপাতা পানিতে ভেজাচ্ছে। কেউ পাখার জন্য বাঁশের শলা কেটে রোদে শুকাতে দিচ্ছে। ঘরের কাজ সামলাতে সামলাতে, বিশ্রাম নিতে নিতে চলছে পাখা তৈরির কাজ।
মাহামুদার বাড়িতে দেখা গেল, তিনি পাখা বানাচ্ছেন। তাঁকে সহায়তা করছে দুই মেয়ে। গ্রামের অন্য ১৫-২০ জন নারীও তাঁর উঠানে বসে পাখা বানাচ্ছেন।
পাখার কারবার শুরু হয় চৈত্র মাস আসার আগেই। চলে কার্তিকের শুরু পর্যন্ত।
তৈরির কৌশল: ঘুরানি, পকেট, হরতন, মোড়া, একডান্ডা, ধাড়াইসহ বিভিন্ন ধরনের পাখা তৈরি করেন তাঁরা। পাখা তৈরিতে মূলত ব্যবহূত হয় তালপাতা, বাঁশ, খুদে পেরেক, সুই-সুতা ও রং। প্রথমে শুকানো তালপাতা চার-পাঁচ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তালপাতা পানি থেকে তুলে বাঁশের কঞ্চির কলম লাগিয়ে রোদে শুকাতে হয়। এরপর রাতে খোলা আকাশের নিচে রেখে সকালে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে তালপাতার চারদিকে গোলাকার করা হয়। সবশেষে পাখায় সুই-সুতার কাজ করা হয়। এরপর রং দিয়ে চোখ জুড়ানো নানা নকশা করা হয়।
পাখা তৈরির কারিগর আসমা খাতুন জানান, একটি তালপাতা তাঁরা নয়-১০ টাকায় গাছের মালিকদের কাছ থেকে কেনেন। একটি তালপাতা দিয়ে ১০ থেকে ১৪টি পর্যন্ত পাখা বানানো যায়। পাইকারেরা গ্রামে এসে পাখা কিনে নিয়ে যায়। এ পাখা চলে যায় দিনাজপুর, রাজশাহী, নীলফামারী, গাইবান্ধা। ঢাকায়ও যায়। প্রতিটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ে দুই থেকে তিন টাকা। বিক্রি হয় আট থেকে ১০ টাকা। একজন কারিগর দিনে ৩০-৩৫টি পাখা তৈরি করতে পারেন।
পরিবারের কথা: মাহামুদাকে নিয়ে গর্বিত তাঁর স্বামী খোয়াজ উদ্দিন। আলাপকালে বললেন, ‘বাহে, আগোত সমাজোত হামার কোনো দাম আছিল না। সোবায় মোক ডাকতো কিষান খাটা কয়া। অভাবের জন্যে মাহামুদার সাথে মোর প্রত্যেক দিন ঝগড়াও নাগছিলো। আশ্বিন-কার্তিক মাসতো থাকপার নাগছিলো সেক আলু উসা (মিষ্টি আলু সেদ্ধ) খায়া। মাহামুদাই সংসারের চাকা ঘুরি দিছে। অর জন্যে হামরা এলা সমাজোত মাথা উঁচা করি চলবার পারি।’
মাহামুদার ছেলে রবিউল ইসলামেরও একই কথা, ‘আগতো গ্রামের ছেলেমেয়েরা হামাক কিষান খাটার বেটা কয়া গালি দিত। এলা ওমরা ফির ডাকি কথা কয়, আদরও করে।’
তাঁরা যা বলেন: সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা সদস্য রেহেনা আক্তার বলেন, আগে ওই গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। তারা সরকারি ত্রাণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে ধরনা দিত। গ্রামের নারীরাও তাঁদের স্বামীর হাতে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতেন। এখন গ্রামটির চিত্র বদলে গেছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুন নবী বলেন, ‘পাশারীপাড়া গ্রামের নারীরা পরিশ্রমী। তাঁরা সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরি করে যেভাবে বাড়তি আয় করছেন, অন্য এলাকার নারীরাও তাঁদের অনুসরণ করে অনুপ্রেরণা পেতে পারেন।’
রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর Prothom-alo

Sunday, August 14, 2011

“পাঁচ তরুণের ব্লগিং সাফল্য” গাথা গল্প নিয়ে কালের কন্ঠ পত্রিকায় রিপোর্ট


গত ৩ আগষ্ট ২০১১ তারিখে কালের কন্ঠ পত্রিকার টেক বিশ্ব পাতায় “পাঁচ তরুণের ব্লগিং সাফল্য” শিরোনামে রিপোর্ট টি তৈরী হয়েছিল। যেখানে কিছু তরুন ব্লগার এবং তাদের গড়া অনলাইন সাপোর্টের সাফল্য সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে এইভাবেঃ
তেজগাঁও কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাসুদুর রশীদের ইন্টারনেটে হাতেখড়ি ২০০৫ সালে। ইন্টারনেটে সার্চ আর ওয়েবসাইট ঘুরেফিরে বেড়ানোই ছিল তখন তাঁর একমাত্র কাজ। এভাবেই কেটে যায় প্রায় তিনটি বছর। ২০০৮ সালে তাঁর বড় ভাই জহিরুল ইসলাম মামুনের কাছ থেকে শেখেন নতুন এক মন্ত্র_ব্লগিং! অনেকে শখের বসে ব্লগিং শেখেন, ব্লগিং করেন। তবে মামুন শিখেছিলেন পেশাগতভাবে। ‘আমার মূল লক্ষ্য ছিল ব্যতিক্রম কিছু করা, ব্লগিংয়ে যুক্ত হওয়ার পর পরই অনেক ভালো লেগে যায় বিষয়টি। এরপর এটিকে পেশা হিসেবে কিভাবে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরামর্শ পাই বড় ভাইয়ের কাছ থেকে।’ ব্লগিং ক্যারিয়ারে আসার শুরুটা এভাবেই বর্ণনা করেন মাসুদ। ব্লগিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে দুই বছরের মাথায়ই উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছেন এ তরুণ। গত মাসে ব্লগ লিখে আয় করেছেন প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা (এক হাজার ৯০০ ডলার)। তবে নিজের এ সাফল্যে থেমে থাকেননি মাসুদ। একই কলেজের সহপাঠী তাহের চৌধুরী সুমনকেও উৎসাহ দিয়েছেন ব্লগিংয়ে, হাতে-কলমে শিখিয়েছেন অনেক কিছু। সুমনের শুরুটা একেবারে গোড়া থেকেই হয়েছিল। ২০০৯ সালের শেষ দিকে তাঁর প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ হয়। ওয়েব সার্ফিংয়েও তখন অনেকটাই কাঁচা ছিলেন তিনি। ২০১০ সালের প্রথম দিকে বন্ধু মাসুদের হাত ধরে তাঁরও শুরু হয় ব্লগিং ক্যারিয়ার। অল্প সময়ে তিনিও পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য সাফল্য। আর মাসুদুরকে ব্লগিংয়ে যিনি হাতেখড়ি দিয়েছিলেন, সেই জহিরুল ইসলাম মামুনও এ সময়ের মধ্যে অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে গেছেন ব্লগিংয়ে। এই দলের তত্ত্বাবধানেই স্বল্প সময়ে সাফল্য পান আরো দুই তরুণ_দিপু শিকদার ও মাসুদুর রহমান। ইন্টারনেটে নিজ নিজ বিষয়ে এখন সবাই প্রায় প্রতিষ্ঠিত ব্লগার, তাঁদের মাসিক আয়ও বেশ উৎসাহজনক।
সমস্যা, তবুও!
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ওয়েবসাইটে লেখালেখি করাকেই মূলত ব্লগিং বলা হয়ে থাকে। আর এসব ওয়েবসাইটে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর সেখানে বিজ্ঞাপন বসিয়ে আয় করতে পারেন ব্লগাররা। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য সবচেয়ে ভালো প্ল্যাটফর্ম হলো, সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগলের ‘গুগল অ্যাডসেন্স’। এ পাঁচ তরুণও ব্লগিং থেকে আয়ের জন্য গুগল অ্যাডসেন্সই বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে সফল ব্লগার হিসেবে নিজেদের পরিচিত করলেও এ সফলতা এক দিনে আসেনি তাঁদের। অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন শুরুর দিকে। মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ব্লগিং শেখার জন্য আমাদের দেশে তখন তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তাই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাই পাইনি ব্লগিং বিষয়ে। কাজ করতে গিয়েও অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছি। এমনকি ইন্টারনেটে কাজ করার জন্য যে ইন্টারনেট গতি দরকার, সেটিও পাইনি। একটি ব্লগ পোস্ট হয়তো লিখতে বসছি, অমনি লুকোচরি খেলছে বিদ্যুৎ।’ তাহের চৌধুরী সুমন বলেন, ‘টাকা আয় করে যে দেশে আনব, সেটির জন্যও নানা প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হচ্ছে আমাদের। পেপালের সুবিধা না থাকায় অনেক কাজের মাধ্যমেই আমরা টাকা আয় করতে পারছি না।’ এমন নানা সমস্যার কথা জানান মামুন, দিপু আর মাসুদুর রহমান। তবে শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাঁরা উল্লেখযোগ্য অবস্থানে পেঁৗছাতে পেরেছেন, নিজেরা যেমন ছাত্রাবস্থায়ই স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি দেশের জন্যও প্রতি মাসে নিয়ে আসছেন হাজার হাজার ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা। আর তাই ফ্রিল্যান্সারদের অর্থ লেনদেন সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে দাবি জানাতেই পারেন তাঁরা।
নতুনদের জন্য পরামর্শ
ব্লগিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পারেন যেকোনো উদ্যমী সৃজনশীল তরুণ। ইন্টারনেটের বিশাল এ প্ল্যাটফর্মটি সবার জন্যই উন্মুক্ত। আর ব্লগিং থেকে আয়ের পরিমাণও তুলনামূলক অনেক বেশি। যাঁদের অনলাইনে কাজ করার যোগ্যতা, ধৈর্য, মননশীলতা এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রয়েছে, তাঁরাই পেশা গড়তে পারেন ব্লগিংয়ে। নতুন যাঁরা ব্লগিংয়ে আসতে চান, তাঁদের জন্য পরামর্শ কী_এ প্রশ্নের উত্তরে জহিরুল ইসলাম মামুন জানান, ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিষয়ে আর্টিকেল লেখা, মতামত প্রকাশ করা আর অন্য ওয়েবসাইটের সঙ্গে নিজ ওয়েবসাইটের সংযোগ স্থাপনই ব্লগিংয়ের মূলমন্ত্র। তবে যাঁরা খুব অল্প সময়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন, তাঁদের জন্য ব্লগিং নয়, একটু সময় নিয়ে এ ক্ষেত্রে আসতে হবে। লেগে থাকতে পারলে সাফল্য আসবেই। দিপু শিকদার জানান, পড়ালেখা বা চাকরির পাশাপাশি যে কেউ এ পেশাকে ‘পার্টটাইম’ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। আর ভালোভাবে সাফল্য লাভ করার পর ফুলটাইম ব্লগার হিসেবেও শুরু করতে পারেন ব্লগিং। এ ক্ষেত্রে রয়েছে কাজের বিশাল সম্ভাবনা।
পাঁচ তরুণের ‘অনলাইন সাপোর্ট’
ব্লগিংয়ে নিজেরা সাফল্য লাভ করায় নতুন ব্লগারদের সাহায্য করতেও উদ্যোগ নিয়েছেন এ পাঁচ তরুণ। তাঁরা এখন নতুনদের ব্লগিংয়ের মাধ্যমে আয়ের বিষয়গুলোও শেখানো শুরু করেছেন। এ জন্য গঠন করেছেন ‘অনলাইন সাপোর্ট’ নামের একটি ব্লগিং ক্যারিয়ার সহায়তা প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে তাহের চৌধুরী সুমন বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক বেকার তরুণ-তরুণী রয়েছে, যারা ব্লগিংয়ের মাধ্যমে টাকা আয় করতে পারে। তাদের সহায়তা করার লক্ষ্যেই বর্তমানে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে আমাদের অনলাইন সাপোর্টে ওয়েব ডিজাইন-ডেভেলপমেন্ট এবং অ্যাডভান্স সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন কোর্স চালু রয়েছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ডেমরায় রয়েছে অনলাইন সাপোর্টের অফিস। তবে অফিসে শেখানোর পাশাপাশি অনলাইনেও তাঁরা নতুনদের ব্লগিং এবং আউটসোর্সিং বিষয়ে তথ্য সহায়তা করছেন। আর এ জন্য তাঁরা www.earntricks.com ঠিকানার একটি বাংলা কমিউনিটি ব্লগও পরিচালনা করছেন।


Sunday, August 7, 2011

তাহমিমার উপন্যাস দ্য গুড মুসলিম


নতুন বই ‘দ্য গুড মুসলিম’ হাতে তাহমিমা আনাম
নতুন বই ‘দ্য গুড মুসলিম’ হাতে তাহমিমা আনাম
প্রথম আলো
সুন্দর নীল শাড়ি পরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে এলেন তাহমিমা আনাম, লন্ডনবাসী বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক, যাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস এ গোল্ডেন এজ ‘শ্রেষ্ঠ প্রথম বই’ হিসেবে ২০০৭ সালে কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। গতকাল বিকেলে প্রথম আলোর কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসে তিনি জানালেন, তাঁর পরিকল্পিত উপন্যাসত্রয়ীর দ্বিতীয়টি সম্প্রতি বের হয়েছে। দ্য গুড মুসলিম নামের বইটি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি ও ভারত থেকে; এবং তিনি উপন্যাসটির ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ বাংলাদেশে প্রকাশের উদ্যোগ নিচ্ছেন।
তাহমিমা আনাম ভারতের মুম্বাই, দিল্লি ও কলকাতায় তাঁর নতুন বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে অংশগ্রহণ শেষে বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁর প্রথম বই এ গোল্ডেন এজ (সোনাঝরা দিন) বাংলাসহ ২৩টি ভাষায় অনূদিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক বাঙালি পরিবারের সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে রচিত, কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কারে ভূষিত উপন্যাসটি দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছিল। বইটির যুক্তরাজ্যে ১০ হাজার ও যুক্তরাষ্ট্রে ২০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল।
দ্য গুড মুসলিম সম্পর্কেও তাহমিমা আনাম নিজের আশাবাদ ব্যক্ত করে জানালেন, বইটির বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের জীবন, যখন এ গোল্ডেন এজ-এর দুই পাত্রপাত্রী মায়া ও সোহেলের পথ দুটি ভিন্ন দিকে বাঁক নিয়েছে। মায়া মানবসেবার পথ বেছে নেয়, আর সোহেল আলিঙ্গন করে ধর্মকে, ছেলেকে পাঠায় মাদ্রাসায়। তাহলে কে ভালো মুসলমান? ঔপন্যাসিক তাহমিমা আনাম এই প্রশ্নটি খোলা রেখেছেন পাঠকদের নিজস্ব বিবেচনার জন্য। কথাশিল্পী হিসেবে তিনি মনে করেন, প্রশ্ন তোলাই তাঁর কাজ, কোনো উত্তর বা রায় চাপিয়ে দেওয়া নয়। দ্য গুড মুসলিম উপন্যাসে তাহমিমা আনাম আশির দশকের বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে ধর্মীয় প্রভাব বেড়ে ওঠার ছবি এঁকেছেন; একই সমাজে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবোধ ও ধর্মীয় অধ্যাত্মবোধের পাশাপাশি অবস্থানের গল্প বলেছেন।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী তাহমিমা আনাম যশস্বী লেখক-বুদ্ধিজীবী আবুল মনসুর আহমদের পৌত্রী, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের মেয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের রয়্যাল হলওয়ে থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তাহমিমা আনাম উপন্যাস লেখার পাশাপাশি লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায়ও লেখালেখি করেন। দ্য গুড মুসলিম উপন্যাসটি ইংরেজি ও বাংলায় বাংলাদেশে প্রকাশের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি জানালেন, এ বিষয়ে প্রথমা প্রকাশনের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা চলছে।
গতকাল বিকেলে প্রথম আলোর কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় উপস্থিত ছিলেন সম্পাদক মতিউর রহমান, উপসম্পাদক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক, সহযোগী সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান, প্রথমা প্রকাশনের জাফর আহমদ, প্রথম আলোর শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকীর দায়িত্ব পালনকারী সহকারী সম্পাদক আলীম আজিজ প্রমুখ।
সূত্র প্রথম আলো

Thursday, July 28, 2011

মানুষ সরওয়ার

সরওয়ার আলম সরওয়ার আলম
রিকশায় উঠতেই টের পাই, চালক অন্য মানুষ। আচার-আচরণ, কথাবার্তা—সবই অন্য রকম। কৌতূহল নিয়ে নাম-পরিচয় জানতে চাই। মুচকি হেসে জবাব আসে, ‘সরওয়ার, সরওয়ার আলম; বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ।’
পথ চলতে চলতে কয়েকটি পারিবারিক ছবি দেখছিলাম। হঠাৎ রিকশাচালক সরওয়ার পেছনে ফিরে একনজর ছবির দিকে তাকান। কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর তাঁর ঝোড়ো মন্তব্য, ‘ছবির কম্পোজিশন ভালো না।’
অবাক হয়ে ভাবি, রিকশাচালক এই ‘কম্পোজিশন’ শব্দ জানল কী করে! বিস্ময় জাগে মনে। তারপর চলতে চলতে গল্প হয় সরওয়ারের সঙ্গে।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে সরওয়ার দ্বিতীয়। ময়মনসিংহের তারাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে পঞ্চম শ্রেণীর পড়ালেখা শেষ করেছেন। ১৯৯৭ সালে পেটের তাগিদে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন তিনি। প্রথমে শাকসবজির দোকানে কাজ করেছেন; পরে কুলিও খেটেছেন। ২০০৩ সাল থেকে রিকশা চালানো শুরু তাঁর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরওয়ার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল, কিন্তু সংসারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ায় তা আর হয়নি। তাই বলে পড়ালেখা থেকে একেবারে দূরেও থাকিনি।’
সরওয়ারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রিকশা চালানোর পাশাপাশি ২০০৫ সালে ইউসেপের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণী পাস করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আর পড়ালেখা হয়নি তাঁর। তবে জ্ঞান আহরণের তীব্র তৃষ্ণা থেকে নিজে নিজেই অনেক কিছু শিখছেন। নজরুলের বিভিন্ন কবিতা, ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস মা, অরুন্ধতী রায়ের দ্য গড অব স্মল থিংকস, লেভ তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, উপন্যাসসহ অনেক কিছুই পড়েছেন তিনি। আর নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাসটা তো তাঁর বেশ পুরোনো। প্রিয় পত্রিকা প্রথম আলোর আদ্যোপান্ত তাঁর মুখস্থ। প্রথম আলোয় প্রকাশিত এবিএম মূসা, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আসিফ নজরুলের কলাম পড়ার চেষ্টা করেন তিনি।
‘কেন এই পড়া?’ জানতে চাই সরওয়ারের কাছে। একটু ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে সরওয়ার বলেন, ‘কত কিছু শেখা যায়, জানা যায়। নিজেকে গড়া, ভাষা-জ্ঞান জানা, মানুষ হওয়া—এসবের জন্যই পড়ি। জ্ঞান-বুদ্ধির ভারসাম্য না থাকলে মানুষ হওয়া যায় না।’
শিক্ষার গুরুত্বটা বোঝেন বলেই অন্য ভাইবোনদের পড়ালেখায় নিয়মিত উৎসাহ দেন সরওয়ার। তাঁর বাকি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চারজনই পড়ালেখা করছেন। তবে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাটা বেশিদূর এগোয়নি বলে স্বপ্ন দেখা থেমে নেই সরওয়ারের। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যান তিনি। গোধূলির আলো-আঁধারির মধ্যেও তাঁর চোখে-মুখে আলো খেলা করে। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে সরওয়ার বলতে থাকেন, ‘ছোটবেলা থেকেই গল্পের বই পড়তাম, ছবি আঁকতাম। এ পর্যন্ত ৫০টা কবিতা লিখেছি, গল্প আছে তিনটা। এখনো স্বপ্ন দেখি লেখক হব। আচ্ছা, এত কম পড়ালেখা নিয়ে কি লেখক হওয়া যায় না? নজরুল তো পড়ালেখা না করেও কত বড় কবি!’
কথা বলতে বলতে সরওয়ারের আরও অনেক সৃজনশীলতার সন্ধান মেলে। সাহিত্যের পাশাপাশি স্থাপত্যবিদ্যায়ও তাঁর আগ্রহ আছে ঢের। এক বছর ধরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষক ফেরদৌস হাবিব খানের কাছে তিনি এ বিষয়ে পাঠ নিচ্ছেন। স্থাপত্যবিদ্যার প্রাথমিক জ্ঞান এখন তাঁর ঠোঁটে ঠোঁটে। প্রশ্ন করি, ‘কী হবে এসব শিখে?’ সরওয়ারের সহজ জবাব, ‘নিজের জন্য একটা খড়ের ঘর বানালেও তাঁর নকশাটা আমার হাতেই হবে।’
সরওয়ার আলম সম্পর্কে ফেরদৌস হাবিব খান বলেন, ‘ও আসলে আমার ভালো বন্ধু। আমি আমার জ্ঞান ওর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আবার ওর কাছ থেকেও আমি অনেক কিছু শিখি। সরওয়ার অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। জানার প্রতি তাঁর আগ্রহের তীব্রতা দেখে আমার অবাক লাগে। রিকশা চালিয়েও শেখার জন্য সে সময় দেয়। এটা সত্যিই বিরল।’
সরওয়ার জানান, একবেলা রিকশা চালিয়ে বাকি সময় জ্ঞান অর্জনের কাজে সময় দেন তিনি। এর মধ্যে সপ্তাহে তিন দিন সন্ধ্যার পর শেখেন স্থাপত্যবিদ্যা। আর অভিধান ঘেঁটে ইংরেজি শব্দ জানার চর্চাটাও করেন মাঝেমধ্যে। হাজার খানেক ইংরেজি শব্দ আছে তাঁর জ্ঞানভান্ডারে। যে কারও সঙ্গে ইংরেজিতে টুকটাক আলাপও করতে পারেন তিনি।
গন্তব্যস্থলের কাছাকাছি এসে সরওয়ারের কাছে জানতে চাই, ‘মানুষ হতে আর কত বাকি!’ সরওয়ারের মুখে লাজুক হাসি। ভেবেচিন্তে দার্শনিকের মতো জবাব দেন, ‘মানুষ হতে হলে আগে দরকার ভালো মানসিকতা। চেষ্টা করি মানুষ হতে, পারছি কিনা মানুষই জানে। মানুষ হওয়া কঠিন কাজ।’
সরওয়ারের কথা শুনে থমকে যাই। নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। আমি নিজে মানুষ হতে পেরেছি তো! সরওয়ারের মতো মানুষ। প্রথম আলো
সাইফুল সামিন
saiful.samin@yahoo.com

Sunday, July 10, 2011

ঢাকার প্রথম মুসলিম নারী চিত্রশিল্পী

  • ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত মেহের বানু খানমের আঁকা ছবি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত মেহের বানু খানমের আঁকা ছবি
  • ছবি আঁকছেন শিল্পী মেহের বানু খানম ছবি আঁকছেন শিল্পী মেহের বানু খানম
1 2
মোসলেম ভারত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আফজালুল হক দুটি ছবি সংগ্রহ করেছেন ঢাকা থেকে। ছবি দুটি এঁকেছেন ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারের নওয়াবজাদি মেহের বানু খানম। পত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছবি দুটি ছাপবেন তিনি।
ছবি দুটির পরিচিতি লিখে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। কবি ছবি দেখে মুগ্ধ। পরিচিতি না লিখে লিখলেন কবিতা। দুটি ছবির একটি তাঁর মনে যে ভাবের জন্ম দেয়, তারই ফসল ‘খেয়াপারের তরণী’ নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কবি নজরুলের বন্ধু মুজফ্ফর আহমেদ লিখলেন, ‘এই কবিতাটিকে ঘিরে যে আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা একান্তভাবে বেগম সাহেবারই।’
একটি ছিল নদী পারাপাররত নৌকার ছবি এবং অন্যটি বিক্রমপুরের একটি গ্রামের দৃশ্য। যেহেতু নজরুল লিখলেন কবিতা, তাই ওই চিত্র দুটির পরিচিতি লেখার দায়িত্ব বর্তাল সেকালের বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলীর ওপর। বেগম সাহেবার দুটি চিত্র ও নজরুলের কবিতা এবং এমদাদ আলীর চিত্র-পরিচয় নিয়ে ১৯২০ সালের আগস্টে অর্থাৎ বাংলা ১৩২৭ সালের শ্রাবণ মাসে কলকাতায় মোসলেম ভারত-এর আলোচিত সংখ্যাটি বের হলো। নদী পারাপাররত ছবিটি রঙিন এবং অপরটি সাদাকালো। অন্য পাতায় কবির পরিচয় ‘হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম’ আর তাঁর কবিতা ‘খেয়াপারের তরণী’ ছাপা হলো। ‘যাত্রীরা রাত্তিরে হ’তে এল খেয়া পার,/ বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জ্জেছে কে আবার?/ প্রলয়েরি আহ্বান ধ্বনিল কে বিষাণে/ ঝঞ্ঝা ও ঘন দেয়া স্বণিল রে ঈশানে!’ ৩০ লাইনের কবিতাটি এভাবেই শুরু হয়েছিল।
ইমদাদ আলী দুটি ছবি নিয়েই বিস্তারিত লিখলেন, যার কিছুটা উল্লেখ করছি। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম চিত্র: ইহা একখানি ধর্মচিত্র। পাপের নদী উত্তাল তরঙ্গে ছুটিয়া চলিয়াছে। এই নদীতে কান্ডারীহীন গোমরাহীর তরণী আত্মরক্ষা করিতে না পারিয়া আরোহীসহ নিমজ্জিত হইতেছে। তাহার হালের দিকটা মাত্র ডুবিতে বাকি আছে। তাহার উদ্ধারের কোন আশা নাই। কিন্তু যাহারা তাওহিদের তরণীতে আশ্রয় লইয়াছেন, তাহারা বাঁচিয়া আছেন, কারণ এই তরণীর কর্ণধার হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স.)। তাহার চারি প্রধান আসহাব এই তরণীর বাহক।
‘দ্বিতীয় চিত্র: পল্লী দৃশ্য। বিক্রমপুরের উত্তর দিকে তালতলা একটি বন্দর। এই বন্দরের পূর্ব দিকের যে গ্রামখানি নদী তীরে বিস্তৃত রহিয়াছে, চিত্রে তাহাই অংকিত হইয়াছে।
‘মৃদুল বায়ু হিল্লোলে নদী বুকে যে তরঙ্গের লীলা আরম্ভ হইয়াছে চিত্রে তাহা বড়ই সুন্দর করিয়া অঙ্কিত হইয়াছে। আলো ও ছায়ার সুসমাবেশে উহা কি মনোরমই না দেখাইতেছে।’
প্রায় শত বছর আগে একজন নারীর, তা-ও আবার রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার থেকে চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। তখন রক্ষণশীল ধ্যানধারণা পোষণের ফলে বিশেষ করে নারীদের সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রটি ছিল রুদ্ধ।
সাধারণ নিয়মানুযায়ী ঢাকার নবাববাড়ির মেয়েদের অন্দরমহলই ছিল একমাত্র ঠিকানা। কিন্তু শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা যদি একবার সত্তায় জেগে ওঠে, তবে তাকে অবদমন করা সত্যিই কঠিন। আর তাই রক্ষণশীল পরিবার ও সমাজের বাধা অতিক্রম করে নিজেকে চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন মেহের বানু খানম।
ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহর কন্যা মেহের বানু খানমের (নবাব সলিমুল্লাহর ছোট বোন) মায়ের নাম ছিল কামরুন্নেসা খানম। মেহের বানুর জন্ম কবে, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। লেখক অনুপম হায়াৎ অনুমান করেন, তাঁর জন্ম ১৮৮৫-৮৮ সালের মধ্যে। হায়াৎ তাঁর পুরনো ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘তাদের বাড়িতে ছিল দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা চিত্র শিল্পীর আঁকা ছবির সংগ্রহ। ছিল অনেক সচিত্র বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা। তিনি এখান থেকেই অঙ্কন চর্চা শুরু করেন। তবে তাঁর অঙ্কন চর্চায় কখনো কোনো জীবজন্তুর অস্তিত্ব থাকতো না। তিনি সব সময়ই প্রকৃতি ও ইসলামের ধর্মীয় চেতনাকে তাঁর শিল্পসত্তায় ধরে রাখতেন।’
দুঃখজনক বিষয় হলো, মোসলেম ভারত-এ প্রকাশিত ছবি দুটি বাদে মেহের বানুর আঁকা আর কোনো ছবি এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে মেহের বানুর চিত্রাঙ্কনরত অবস্থার একটি আলোকচিত্র পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, তিনি ইজেলের ওপরের দিকে সেঁটে রাখা একটি চিত্রের অনুকরণে ঠিক নিচেই আরেকটি কাগজে ছবি আঁকছেন। লক্ষ করলে বোঝা যায়, এটি নদীতে একটি নৌকার দৃশ্য। আলোকচিত্রে দৃশ্যমান চিত্রটি এবং প্রকাশিত অন্য চিত্র দুটি বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে তিনি ‘ল্যান্ডস্কেপ’ই বেশি আঁকতেন। এই তিনটিই নদীর দৃশ্য। সুতরাং নদী ও নৌকা, সম্ভবত, তাঁর আঁকা ছবিতে বারবার এসে থাকবে। এ সবই অনুমান মাত্র। মেহের বানুর আরও ছবি পাওয়া গেলে তাঁর ছবির বিষয় ও মান সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হওয়া সম্ভব হবে।
সম্ভবত, ১৯১২-১৩ সাল থেকে মেহের বানু ছবি আঁকা শুরু করেন। মেহের বানুর বিয়ে হয় ২৫ পৌষ ১৩০৮ বাংলা সালে অর্থাৎ ১৯০২ সালে। তাঁর স্বামী খাজা মোহাম্মদ আজম ছিলেন একজন সাহিত্যিক এবং ঢাকার পঞ্চায়েত সরদারদের তত্ত্বাবধায়ক। ঢাকার ওপর একটি উল্লেখযোগ্য বই দ্য পঞ্চায়েত সিসটেম অব ঢাকা তাঁরই লেখা। এ জন্য সংস্কৃতিমনা স্বামীর কাছ থেকে মেহের বানু শিল্পসাধনায় সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
এই সংস্কৃতিমনা পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরাও ঢাকার ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সেই সময়ে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তাঁর এক ছেলে খাজা মোহাম্মদ আদিল ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক ও জাদু পত্রিকার সম্পাদক। খাজা আদিল ও তাঁর ভাই খাজা আজমলের উদ্যোগে ঢাকায় ১৯২৯-৩১ সালে ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস ও সুকুমারী নির্মিত হয়। দ্য লাস্ট কিস-এর নায়ক ছিলেন খাজা আজমল নিজেই।
মেহের বানু খানম ১৯২৫ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে দিলখুশা মসজিদের পূর্ব পাশে নবাব পরিবারের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনিই ঢাকার প্রথম নারী চিত্রশিল্পী।
প্রথম আলো

Friday, July 1, 2011

রিকশা চালিয়ে হাসপাতাল


ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালাচ্ছেন জয়নাল আবেদিন
ঢাকায় রিকশা চালান তিনি। রোদে পোড়েন। বৃষ্টিতে ভেজেন। কাঁপেন কনকনে শীতে। তবু থামে না রিকশার চাকা। এ যে তাঁর স্বপ্নেরও চাকা।
তিনি মো. জয়নাল আবেদিন। বয়স কত হবে? ৬০ কিংবা ৬১। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। কালো হয়ে গেছে দাঁত। দাড়ি শ্বেতশুভ্র। শরীর দুর্বল। রিকশার প্যাডেল চাপতে এখন পা ধরে আসে। পেশি টনটন করে। মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু স্বপ্ন তাঁকে টেনে নিয়ে যায়।
ঢাকায় জয়নাল যখন কষ্টে কাতর, ময়মনসিংহে তখন তাঁর গড়া হাসপাতালে গরিব রোগীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঢাকার বালি-ধূলি-ভেঁপুর শোরগোল চাপা পড়ে যায় জয়নালের অন্তরে বাজা তাঁর গড়া বিদ্যালয়ের শিশুদের হিল্লোলের নিচে।
একজন জয়নাল শুধু রিকশা চালিয়ে নিজ গ্রামে একটি হাসপাতাল করেছেন। গড়েছেন একটি বিদ্যালয়। চালাচ্ছেন মক্তব। ছোট তাঁর সেই হাসপাতালে ছয়টি শয্যা আছে। আছেন একজন পল্লি চিকিৎসক, সার্বক্ষণিক। সপ্তাহে এক দিন সরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক এসে রোগী দেখেন।
শুধু রিকশা চালিয়ে একজন অক্ষরজ্ঞানহীন জয়নাল একটি বিদ্যালয় গড়েছেন। হোক সেখানে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা। তাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ১২০। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে সকালে মক্তব বসে। গ্রামের শিশুরা সকালে সেখানে আরবি পড়ে। সাধ্য নয়, স্বপ্ন একজন রিকশাচালককে দিয়ে কী না গড়িয়ে নেয়! 
আঘাত থেকে অঙ্গীকার: ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টানহাসাদিয়া গ্রামে জয়নাল আবেদিনের বাড়ি। বাবা মো. আবদুল গনি ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। আবদুল গনির চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে জয়নাল সবার বড়। অভাব-অনটনের সংসারে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি কারও। 
প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই জয়নালের। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যার দিকে বাবা আবদুল বুক চেপে ধরে কাতরাতে লাগলেন। বাবার কষ্টকাতর মুখ দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লেন সন্তানেরা। জয়নাল ও তাঁর ভাইয়েরা বের হলেন চিকিৎসকের খোঁজে। সে যুগে কাছেপিঠে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র বা ভালো চিকিৎসকও ছিল না। গুটিকয়েক নাম ভাঙানো চিকিৎসক ও ওষুধের দোকান ছিল ভরসা। 
জয়নাল বললেন, ‘একপর্যায়ে রাত আটটার দিকে বাবাকে নিয়ে দুই কিলোমিটার দূরে মীরকান্দাপাড়ায় যাই। সেখানে মেহছেন বেপারীর ওষুধের দোকান ছিল। মেহছেনের বাবা জসিমউদ্দিন ছিলেন এলাকার কুখ্যাত রাজাকার। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে দোকানে পৌঁছালে মেহছেন তাচ্ছিল্য করে বলে, রাজাকারের দোকানে ওষুধ নিতে আইছো ক্যান? তোমরার কাছে ওষুধ বেচুম না।’
বিমুখ হয়ে মুমূর্ষু বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন ছেলেরা। রাত ১০টার দিকে বাবা মারা যান। এই মৃত্যু স্তব্ধ করে দেয় জয়নালকে। কষ্টের আগুনে পুড়তে থাকেন তিনি। 
পেছনে চোখ ফেলেন জয়নাল। তাঁর এক মামা ময়মনসিংহের ব্যাংকে চাকরি করতেন। তাঁর সূত্রে ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় একদল মুক্তিযোদ্ধা আসেন তাঁদের বাড়িতে। তাঁর বাবা সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েক দিন বাড়িতে রেখে খাইয়েছেন। সে ইতিহাস জয়নালরা ভুলে গেলেও স্থানীয় রাজাকার জসিমউদ্দিন বা তাঁর ছেলে তা ভোলেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জয়নাল। 
মনের আগুন থেকে অঙ্গীকার। একটি হাসপাতাল গড়ার পণ করেন জয়নাল। সেই হাসপাতালে বিনা মূল্যে গরিব মানুষের চিকিৎসা হবে। ঠিক করেন, ঢাকায় চলে যাবেন। গতর খেটেই হাসপাতাল গড়ার টাকা জোগাবেন।
বাবার কুলখানির পর গাঁয়ের কয়েকজন মুরব্বি নিয়ে বসলেন জয়নাল। তাঁদের বলেন, ‘এই রইল আমার মা আর ভাইবোনরা। ওগো সমস্যা হইলে আপনেরা দেইখেন। আমি চললাম।’ স্ত্রী লাল বানু ও দেড় বছরের মেয়ে মমতাজকে নিয়ে ট্রেনে ঢাকার পথে ছোটেন জয়নাল। 
সাহসী যাত্রা: ঢাকায় পৌঁছে যেন গোলকধাঁধায় পড়ে যান জয়নাল। নতুন শহর। আপনজনহীন। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। ট্রেন থেকে নেমে স্ত্রী ও শিশুকন্যা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় মাঠে গিয়ে পৌঁছেন তিনি। পরে জেনেছেন, এটি শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠ। ওই মাঠে পানির ট্যাংকের নিচে সপরিবারে আশ্রয় নেন জয়নাল। সেখানে কাটে দেড় দিন। কত সালে জানতে চাইলে বলেন, ‘তখন এরশাদের আমল।’
পরিবারটির ব্যাপারে কৌতূহলী হন স্থানীয় মোশাররফ (৪৫)। তাঁর বাড়ি বিক্রমপুরে। কয়েকটি রিকশা ভাড়া খাটাতেন তিনি। জয়নালের সব জেনে মায়া হয় তাঁর। খাওয়ার জন্য ৫০ টাকা দেন। মোশাররফ এক দিনেই রিকশা চালানো শিখিয়ে একটি রিকশাও দেন জয়নালকে। সঙ্গে কলোনির একটি বাসার বারান্দায় ১৫০ টাকা ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থাও করে দেন।
জয়নাল স্মৃতিচারণা করেন, ‘প্রথম খেপে বাদামতলীতে গিয়ে ৩০ টাকা পাই। এভাবে এক দুপুর রিকশা চালিয়ে পাই ৯৫ টাকা। বাকি বেলায় জোটে ৫৫ টাকা। মোশাররফকে রিকশার জমা দেই ২০ টাকা। সপ্তাহ খানেক এভাবে চলে।’ 
অঙ্গীকার পালনের তাড়া আর স্বপ্নের হাতছানি জয়নালকে পরিকল্পনা শেখায়। হাসপাতাল গড়তে হলে তিল তিল করে করতে হবে বড় সঞ্চয়।
এক মনে সঞ্চয়: তত দিনে আপনজন হয়ে ওঠা মোশাররফকে অকপটে হাসপাতাল গড়ার স্বপ্নের কথা জানান জয়নাল। মোশাররফের পরামর্শে স্থানীয় এক মুদি দোকানির কাছে কিছু টাকা জমান জয়নাল। ওই টাকা নিয়ে ব্যাংকে হিসাব খুলতে গেলে শুরুতে কর্মকর্তারা পাত্তাই দেননি। অবজ্ঞাভরে বলেছেন, ‘রিকশাওয়ালা! কিছু টাকা জমিয়ে কয় দিন পর ঋণ চাইতে আসবে।’
কিন্তু দমেননি জয়নাল। বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে হিসাব খুলতে ধরনা দেন। শেষে সোনালী ব্যাংক মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপক সালেহা আক্তার তাঁর আবেগের মূল্য দিলেন। তাঁর সহযোগিতায় ডিপিএস হিসাব খুলে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে জমাতে লাগলেন জয়নাল। একই ব্যাংকের দিলকুশা শাখায়ও একটি হিসাব খুললেন তিনি। সেখানে ডিপিএস করেন ৫০০ টাকার।
‘নিয়মিত টাকা জমাতে গিয়ে জান দিয়ে খাটতে হয়েছে। কখনো রাতদিন রিকশা চালিয়েছি। টাকা জমানোর কথা স্ত্রীকে জানাইনি। সংসারে যত কষ্টই হতো, কখনো জমানো টাকায় হাত দেইনি।’ বললেন জয়নাল।
এর মধ্যে সংসারে ছেলে জাহিদ হাসানের আগমন ঘটেছে। মগবাজারের উদয়ন ক্লিনিকে আয়ার কাজ নিয়েছেন স্ত্রী লাল বানু। চিকিৎসক জাহাঙ্গীর কবির একদিন জয়নালের রিকশায় করে যাচ্ছিলেন। কথায় কথায় জয়নাল চিকিৎসককে তাঁর সংকল্পের কথা জানান। ওই চিকিৎসকই জয়নালের স্ত্রীকে কাজটি পাইয়ে দেন। দীর্ঘদিনের চর্চায় প্রসূতি নারীর আনুষঙ্গিক সহযোগিতার কাজে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন লাল বানু।
কায়ক্লেশে প্রায় ২০ বছর রাজধানীতে কেটে যায় জয়নাল পরিবারের। এতগুলো বছর গোপনে জমা হয়েছে জয়নালের রক্তমাংস নিংড়ানো টাকা।
ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। মেয়ে মমতাজের বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহে। ছেলে জাহিদ হাসান এইচএসচি পাস করে এখন মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে মোবাইল ফোনসেট মেরামতের দোকান দিয়েছেন। তিনিও দুই সন্তানের জনক। 
স্বপ্নের খুঁটি গাড়া: ২০০১ সালে স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন জয়নাল। সব সঞ্চয় এক করে পান এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। তা নিয়ে গ্রামে ফেরেন তিনি। বাড়ির কাছে ৪০ হাজার টাকায় ২৪ শতাংশ জমি কেনেন। এক শুক্রবারে গাঁয়ের মানুষ ডেকে হাসপাতাল গড়ার ঘোষণা দেন জয়নাল—‘এইহানে বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হইব।’
লাল বানু বললেন, ‘লোকজন খুশি হবে কি, হেসেই উড়িয়ে দিল। হাসপাতাল গড়বে রিকশাচালক জয়নাল আবেদিন!’ আরও যোগ করলেন, ‘মাইনসের কতা কি কমু, আমার নিজেরই তহন তাঁরে পাগল মনে অইত। এহন হেই কথা ভাবলে কষ্ট লাগে।’
আপনজনরা টাকা অপচয় হবে বলে জয়নালকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু জয়নাল স্বপ্ন জয় না করে ছাড়বেন না। নতুন কেনা জমিতে দোতলার ভিত্তি দিয়ে একটি বড় আধাপাকা ঘর তৈরি করেন। এই নির্মাণকাজে সঞ্চয়ের প্রায় পুরো টাকা চলে যায়। মেয়ের নামে হাসপাতালের নাম দিলেন তিনি ‘মমতাজ হাসপাতাল’। 
হাসপাতালে একদিন: সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহর থেকে নৌকায় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে মোটরসাইকেলে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছি সিরতা বাজার। মনিহারি দোকানে কয়েকজন লোক বসা। উদ্দেশ্য জানালে এক যুবক নিয়ে গেলেন জয়নালের বাড়ি। বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে।
বাড়ির সামনে বাঁশের খুঁটিতে একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা মমতাজ হাসপাতাল। পেছনে প্রায় ২৫ ফুট দীর্ঘ একটি টিনশেড ঘর। এটাই জয়নালের হাসপাতাল ভবন। 
উঠানে গাভির পরিচর্যা করছিলেন জয়নাল। আগন্তুক দেখে কাছে এসে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী সৌম্যকান্ত জয়নাল। মৃদু হেসে পরিচয় জানতে চাইলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সোৎসাহে দেখাতে লাগলেন তাঁর হাসপাতাল। 
হাসপাতাল বলতে প্রচলিত অর্থে যা বোঝায়, জয়নালের আয়োজন তা নয়। তবে জয়নাল তাঁর ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে যেভাবে তিন দশক ধরে লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন, তার মাহাত্ম্য অনেক বড়। এ মাহাত্ম্য একটি হাসপাতাল গড়ার চেয়েও বিশাল।
ঘরটি দুটি কক্ষে বিভক্ত। একটি কক্ষে রোগীদের জন্য ছয়টি শয্যা। অন্য ঘরে একপাশে চিকিৎসক ও রোগীর বসার ব্যবস্থা। অন্য পাশে রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষায় নানা বয়সী ১০-১২ জন নারী-পুরুষ। বেশভুষায় দারিদ্র্য। সময় গড়াচ্ছে, রোগীও বাড়ছে। সকাল নয়টার দিকে মোটরসাইকেলে চেপে হাসপাতালে এলেন পল্লি চিকিৎসক মো. আলী হোসেন। বারান্দায় টেবিল পেতে শুরু করলেন রোগী দেখা। পাশে বসে খাতায় রোগীর নাম-পরিচয় লিখছে জয়নালের নাতনি মমতাজের মেয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রী আল্পনা। জয়নালের পুত্রবধূ এসএসসি পাস তামান্না ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিনা মূল্যে ওষুধ দিচ্ছিলেন রোগীদের। ভেতরে একটি শয্যায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত একজনকে স্যালাইন নেওয়ায় সহযোগিতা করছেন লাল বানু, জয়নালের স্ত্রী। জয়নাল ঘুরে ঘুরে রোগীদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। 
নয়াপাড়ার কৃষিশ্রমিক মজিবর (৩৫) বলেন, ‘মাইনসের খেতে কাম কইরা খাই। জ্বরে পইড়া কাইল আইছিলাম। আইজ একটু ভালা। এহানে ডাক্তার দেহাইতে টেহা লাগে না। ওষুধও মাগনা।’
পাশের হইল্লাবাড়ি গ্রামের আমেনা খাতুন (৬০) বলেন, ‘আগে অসুখ অইলে চাইর-পাঁচ মাইল হাইট্টা পরানগঞ্জ যাইতে হইত। এহন কাছেই চিকিৎসা। এইহানে চিকিৎসা করাইতে টেহা লাগে না। ডাক্তারও ভালা।’ উপস্থিত অন্য রোগীরা তাঁর কথায় সায় দিলেন। 
পল্লি চিকিৎসক আলী হোসেন শুক্রবার বাদে প্রতিদিনই আসেন। সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত রোগী দেখেন। প্রতিমাসে তিনি দেড় হাজার টাকা বেতন পান। 
আলী হোসেন বলেন, ‘শুরুতে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে গাঁয়ের লোকজন হাসাহাসি করত। এখন আর তা নেই। প্রতিদিন এখানে ২৫-৩০ জন রোগী আসে। জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, কাটাছেঁড়ার রোগী আর গর্ভবতী মারা আসেন এখানে। তাদের আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসা ও ওষুধ দেই। হাসপাতালের যাবতীয় খয়খরচা জয়নাল কাকা চালান। কাকি (লাল বানু) ধাত্রীবিদ্যার কৌশল জানেন বলে এখানে অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের ব্যবস্থাও আছে।’
প্রতি বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালের বক্ষব্যাধির চিকিৎসক হেফজুল বারী আসেন মমতাজ হাসপাতালে রোগী দেখতে। ওই দিন রোগী হয় সবচেয়ে বেশি।
যেভাবে ব্যয় নির্বাহ: জয়নাল জানান, বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন দুই বেলা রিকশা চালিয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পান। সপ্তাহে তিন-চার দিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তার সিংহভাহ দিয়ে ওষুধ কিনেন হাসপাতালের জন্য। বাকি টাকায় বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ি ফেরেন। দিন দুয়েক বাড়িতে থেকে আবার ছোটেন ঢাকায়। এভাবে চলে এখন জয়নালের দিনকাল।
জয়নাল জানান, গ্রামে কিছু জমি বর্গা নিয়ে ধান, মরিচ ও সবজি চাষ করছেন। বাড়িতে একটি দুধেল গাই বর্গায় পালন করছেন। একটি ছোট পুকুরে মাছ চাষও করছেন। এসবের আয় দিয়ে এখন কোনো মতে চলে যায় তাঁর।
জয়নাল জানেন, তাঁর শারীরিক শক্তি যত দিন আছে তত দিন চলবে এই হাসপাতাল। কিন্তু তারপর কী হবে? সহায়তার জন্য অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিতে শুরু করেছেন জয়নাল। বিমুখ হয়েছেন, হয়েছেন প্রতারিতও।
২০০৫ সালে তাঁর হাসপাতালের কথা জানতে পেরে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শাহনাজ পারভীন এক হাজার ডলার পাঠান। যার কাছে সেই টাকা পাঠানো হয়েছিল তিনি তাঁর বড় অংশই মেরে দেন। কিছু টাকা অনেক কষ্টে উদ্ধার করে হাসপাতালের জন্য কিছু আসবাব কেনেন জয়নাল। কাটান একটি ছোট পুকুর। 
এই প্রতিবেদকের কাছে জয়নালের হাসপাতাল সম্পর্কে জেনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, ‘আমি সংগঠনের মাধ্যমে সেখানে সপ্তাহে অন্তত একজন চিকিৎসক পাঠানোর ব্যবস্থা করব।’
ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) এ বি এম মোজাহারুল ইসলাম বললেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এখন আমি আমার সাধ্যমতো সহযোগিতা করব।’
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, ‘ওই হাসপাতালের জন্য ওরস্যালাইনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব, তার ব্যবস্থা আমি নেব।’ 
বিদ্যালয়: হাসপাতালের পাশে একটি ছোট দোচালা ঘর। এখানেই বিদ্যালয় ও মক্তব চালু করেছেন জয়নাল। সকালে মক্তবে শিশুরা এসে আরবি শেখে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত চলে প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান।
বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের একজন ফলিয়ামারীর এসএসসি পাস যুবক মো. আইয়ুব আলী জানান, বিদ্যালয়ে এখন ১২০ জন শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে ৭০ জনের মতো ছাত্রী। তাদের বিনা মূল্যে বই-খাতা দেওয়া হয়। কোনো ফি নেওয়া হয় না।
সরকারি বই পান কি না জানতে চাইলে জয়নাল বলেন, ‘না। আমি বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে পুরোনো বই চেয়ে আনি। সামান্য কিছু লাগলে কিনে নিই। খাতা-কলম-চক-পেনসিল কিনে দেই।’
তৃতীয় শ্রেণী পাস করে শিক্ষার্থীরা কোথায় যায়—জানতে চাইলে শিক্ষক আইয়ুব আলী জানান, সিরতা-নয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এক মাইল দূরের ফলিয়ামারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
যা কিছু প্রাপ্তি: জয়নাল গরিব, কিন্তু তাঁর হাসিটা কোটি টাকা দামের! হাসিতে থাকে তৃপ্তির আলোকছটা। স্বপ্নের হাসপাতাল তাঁকে এই তৃপ্তি দিয়েছে। এই মানুষটি মনের দিক থেকে কেমন? ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৮ জুন ‘এসো বাংলাদেশ গড়ি’ শীর্ষক রোড শো চলাকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে সনদ ও পদক দেওয়া হয়। 
জয়নাল বলেন, ‘শেষ বয়সে আমি আর কী চাইব? এলাকার মানুষ যে আমার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন, এটাই আমার বড় পাওয়া।’
অসম্ভবকে জয় করা জয়নাল পড়ন্ত বয়সেও কারও আশায় বসে থাকতে রাজি নন। জীবিকার পথে এখনো সচল তিনি। রিকশা চালিয়ে যে টাকা পান, তা দিয়েই চালান হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও মক্তব। এতেই তাঁর সুখ।

Saturday, June 25, 2011

তিন কন্যা এক ছবি


তিন বোন তিন ফুটবলার
ফেনীর একই পরিবারের তিন মেয়ে ফুটবলার। তাদের ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প শোনাচ্ছেন বদিউজ্জামান

আবদুল মালেক মজুমদারের ছোট মেয়ের নাম বাবু। বাবু আবার মেয়েদের নাম হয় নাকি? প্রশ্নটা করতেই বাবুর উত্তর, ‘সবার ছোট বলে আদর করে সবাই বাবু নামেই ডাকত আমাকে, সেই থেকে আমি বাবু।’ পুরো নাম সৌদিয়া আক্তার বাবু। ফুলগাজী পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী বাবু এবারের জাতীয় মহিলা ফুটবলের আঞ্চলিক পর্বে খেলল ফেনী জেলা দলের হয়ে। সে দলের মূল গোলরক্ষক। আবদুল মালেকের আরও দুই মেয়ে খেলে ফেনী দলে। রাবেয়া আক্তার কাকন স্ট্রাইকার, ফৌজিয়া আক্তার বিন্তু ডিফেন্ডার। 
চূড়ান্ত পর্বে ওঠার জন্য বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে কিশোরগঞ্জের সঙ্গে প্লে-অফ ম্যাচ খেলে ফেনী। কিন্তু টাইব্রেকারে হেরে হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরতে হয়েছে তিন বোনকে।
আবদুল মালেকের পরিবারটাই ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ। তিন মেয়ের পাশাপাশি ছেলে নুরুল হক পেশাদার ফুটবল লিগের দল ফেনী সকার জুনিয়র দলের গোলরক্ষক। আরেক ছেলে আবদুল্লাহ মজুমদার খেলছে নোয়াখালী লিগে।
আর দশজন অভিভাবক যেখানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন নিয়ে লেখাপড়া শেখান ছেলেমেয়েদের, সেখানে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কর্মকর্তা আবদুল মালেক শুরু থেকে জোর দেন ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার ওপর। ‘নিজেও ফুটবলার ছিলাম। আশির দশকে খেলেছি ফেনী দলে। আমার মেয়ে বিন্তু সাত বছর ধরে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলে। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন। অ্যাথলেটিকসেও ভালো। কাকন দুই বছর ধরে জেলা পর্যায়ে খেলে। বড় ভাই আবদুল গোফরান মজুমদার স্বাধীনতার আগে ফুটবল খেলেছেন। যখন দেখি ওরা খেলাধুলায় ভালো করছে, তখন বাধা দিই না।’ বলেন গর্বিত মালেক।
ফুটবলে কত মেয়েই তো আসে, আবার হারিয়েও যায়। বাবু-কাকনরা টিকে থাকতে পারবে? অন্তত স্বপ্ন দেখতে বাধা নেই আবদুল মালেকের, ‘আগেভাগেই ওদের বিয়ে দিতে চাই না।’ শত ব্যস্ততার মধ্যেও মেয়েদের খেলা দেখতে তিনি স্টেডিয়ামে ছুটে যান স্ত্রীকে নিয়ে। কমলাপুরে ফেনীর প্রথম ম্যাচেও সস্ত্রীক দেখা গেছে তাঁকে। 
ফুলগাজী পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী কাকন হতে চেয়েছিল ক্রিকেটার। কাকন জানায়, ‘প্রথমে আমার ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ছিল। ব্যাডমিন্টনও খেলতাম। আমাদের স্থানীয় কোচ দীপক স্যার (দীপক চন্দ্র) একদিন আমাকে ফুটবল খেলতে দেখেন। আমার খেলায় মুগ্ধ হয়ে ফুলগাজী মহিলা ফুটবল দল গড়ার সময় আমাকে ডাকেন। প্রথম প্রথম জার্সি পরে, ট্র্যাকসুট পরে প্র্যাকটিসে যেতে দেখলে পাড়ার ছেলেরা হাসাহাসি করত। ঠাট্টা করে বলত, এই মেয়ে খেলোয়াড় হবে! শুনে খুব কষ্ট লাগত। কিন্তু এখন আর কেউ কিছু বলে না।’
ঢাকায় নরসিংদীর বিপক্ষে কাকনের জোড়া গোলেই জিতেছিল ফেনী। দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে কাকনের, ‘এর আগে কখনো ফ্লাডলাইটে খেলিনি। সেদিন তাই খুব ভয় করছিল। একটু নার্ভাসও লাগছিল। এত বড় মাঠ, এর ওপর আবার ফ্লাডলাইটে খেলা।’
ফুলগাজী মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী বিন্তুও ‘অলরাউন্ডার’, ‘ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, সাঁতার—তিনটিতেই পারদর্শী আমি। তবে ফুটবলই বেশি ভালো লাগে। জাতীয় দলে নাম লেখানোর স্বপ্ন আমার।’ সবার ছোট বাবু ভালো গান গাইতে পারে। খেলার জন্য গান ছেড়ে দিয়েছে। 
তিন বোনেরই প্রিয় ফুটবলার লিওনেল মেসি। বাংলাদেশে এলে ঢাকায় স্টেডিয়ামে এসে আর্জেন্টাইন তারকার খেলা দেখবে বলেও জানাল তারা।
ফেনীর কোচ তৌহিদুল ইসলাম এই মেয়েদের মধ্যে দেখছেন দারুণ সম্ভাবনা, ‘ওরা তিন বোনই খুব ভালো খেলে। সঠিক পরিচর্যা পেলে ওরা আরও ভালো ফুটবলার হয়ে উঠবে।’ 
সেই স্বপ্ন নিয়েই কাকন-বিন্তু-বাবুদের এগিয়ে চলা।

Tuesday, June 21, 2011

পলিথিন মিশে যাবে মাটিতে!



এক্সটোডার যন্ত্রে বিকল্প পলিথিন তৈরির কাঁচামাল ঢালছেন এস এম ওয়াহিদুজ্জামান
এমন পলিথিন, যা মিশে যায় মাটির সঙ্গে। পরে এটি পরিবেশবান্ধব ও ধীরগতির সার হিসেবে ব্যবহূত হবে। আর এ পলিথিন তৈরিতে ব্যবহূত হয়েছে পরিচিত সব জিনিস। ক্ষতিকর পলিথিনের মাটিতে মিশ্রণীয় পরিবেশবান্ধব এমনই এক বিকল্প উদ্ভাবন করেছেন অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান। মাটিতে মিশে যায় এমন পলিথিন তৈরির খবর শোনা যায়। তবে মাটিতে মিশ্রণীয় পলিথিন তৈরিতে ওয়াহিদুজ্জামানের পদ্ধতিটি নতুন।ভাতের মাড়, চালের গুঁড়া, আলু, অ্যারারুট প্রভৃতি শ্বেতসার-জাতীয় পদার্থের সঙ্গে পলিভিনাইল অ্যালকোহল (পিভিএ), জিগাগাছের আঠা, ইউরিয়া, চিনি, সয়াবিন তেল মিশিয়ে বিকল্প পলিথিন উদ্ভাবন করেছেন তিনি।
বিকল্প এই পলিথিন ছিল এস এম ওয়াহিদুজ্জামানের পিএইচডি গবেষণার বিষয়। গত ৯ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের এক বিশেষ সভায় রসায়ন বিভাগের গবেষক এস এম ওয়াহিদুজ্জামানকে তাঁর ‘প্রিপারেশন অ্যান্ড ক্যারেক্টারাইজেশন অব বায়োব্লেন্ড অব ন্যাচারালি অকারিং পলিমারস অ্যান্ড ওয়াটার সুলিউবল পলিমারস টেকনিক’ শিরোনামের অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয়। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোবারক আহমদ খানের যুগ্ম তত্ত্বাবধানে তিনি এ গবেষণা সম্পন্ন করেন।
ওয়াহিদুজ্জামান জানালেন, রাসায়নিক পদার্থ ইথিলিনের পলিমার হচ্ছে পলিথিন। এই পলিথিন মাটি ও পানিতে মিশ্রণীয় না হওয়ায় পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। তা ছাড়া সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্ব ক্ষতিকর পলিথিনে মোড়কজাত দ্রব্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে। আমাদের দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে প্যাকেজিংয়ের কাজে ক্ষতিকর পলিথিন ব্যবহার করা হয়। সুবিধাজনক কোনো বিকল্প না থাকায় অনেকেই বাধ্য হয়ে এ পলিথিন ব্যবহার করছে। তাই সব দিক মিলিয়ে এই ক্ষতিকর পলিথিনের বিকল্প উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
ঠিক এমন সময়ই অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান ভাতের মাড়, চালের গুঁড়া, আলু, অ্যারারুট প্রভৃতি শ্বেতসার-জাতীয় পদার্থের সঙ্গে পলিভিনাইল অ্যালকোহল (পিভিএ), জিগাগাছের আঠা, ইউরিয়া, চিনি, সয়াবিন তেল মিশিয়ে পলিথিনের মতোই এর বিকল্প উদ্ভাবন করেন। গামা রশ্মি বিকিরণের সাহায্যে উৎপন্ন পলিমারকে ক্রস লিংক বা আড়াআড়ি সংযোগ ঘটিয়ে এর গুণগত মান এবং উৎকর্ষ সাধন করা হয়েছে। বাজারে প্রচলিত পলিথিনের মতো এমন একটি পণ্য বানাতে ২০ শতাংশ চালের গুঁড়া, ১০ শতাংশ ইউরিয়া ও ৭০ শতাংশ পিভিএ ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের বিকল্প পলিথিন মাটির মধ্যে ৪২ দিনে ৩০ শতাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং ধীরে ধীরে এটি পুরোপুরি ক্ষয় হয়ে যায়। এটি পানির মধ্যে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পর ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। তবে পিভিএর পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর স্থায়িত্ব ও টেকসইয়ের মানও বাড়ানো যায়। এটি সাশ্রয়ী এবং মাটিতে মিশ্রণীয় বলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।
ওয়াহিদুজ্জামান জানান, বাজারে প্রচলিত পলিথিন পরিবেশের জন্য হুমকি হওয়ায় এর বিকল্প উদ্ভাবনের চেষ্টা চালানোর পর তাঁরা সাফল্য অর্জন করেন। এটি বানাতে প্রাকৃতিক এবং শ্বেতসার বা স্টার্চ-জাতীয় পদার্থের সঙ্গে পলিভিনাইল অ্যালকোহল (পিভিএ) মিশিয়ে পলিথিনের বিকল্প পলিমার-জাতীয় পদার্থ উদ্ভাবন করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেই পলিমারকে এক্সটোডার যন্ত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরিপূর্ণভাবে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হয়। এ ছাড়া এর মধ্যে ইউরিয়া থাকায় মাটিতে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এটি ধীরগতির সার হিসেবেও ব্যবহূত হবে। প্রচলিত পলিথিনের চেয়ে এর দাম একটু বেশি হলেও বাণিজ্যিকভাবে এটি উৎপাদন করা হলে দাম প্রচলিত পলিথিনের সমপর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি জানান।
এস এম ওয়াহিদুজ্জামান বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আটটি পাঠ্যপুস্তকের রচয়িতা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকীতে তাঁর চারটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হন। ২০০৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ফেলোশিপ অর্জন করেন।

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons