Total Pageviews

Friday, October 21, 2011

 নিপীড়িত মানুষের প্রেরণা

  • ইলা মিত্র (জন্ম: ১৯২৫—মৃত্যু: ২০০২) ইলা মিত্র 
 কলকাতায় আন্দোলনের সময় বন্দী ইলা মিত্র
কলকাতায় আন্দোলনের সময় বন্দী ইলা মিত্র
মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ইলা মিত্র কিংবদন্তিসম এক নাম। তাঁর যুগে শ্রমের ফসল কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে যা ছিল বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, আজ তা হয়েছে জাতিসত্তার পরিচয় কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে অন্তহীন সংগ্রাম। গত ১৮ অক্টোবর ছিল মহীয়সী এই নারীর জন্মদিন।

ইলা মিত্র (১৯২৫-২০০২) নিত্যস্মরণীয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্র। সংগ্রামী মানুষের আন্দোলনের ইতিহাসে দেশ-কাল-ধর্ম-জাতি-শ্রেণী-লিঙ্গ তুচ্ছ করা অনমনীয় মৃত্যুহীন প্রাণ ইলা মিত্র। তাঁর ইতি নেই। অন্তহীন তাঁর ইতিহাস, ইতিবৃত্ত ও ইতিকথা। আজও তাঁর নাম, তাঁর সংগ্রামের প্রেরণা নাচোলের অধিকারহারা সাঁওতাল জনগণের প্রাণে সাড়া জাগায়। আজও বাংলাদেশের সংগ্রামী অধিকারহারা যেকোনো স্তরের এবং শ্রেণীর মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার শক্তি সঞ্চয় করার জন্য ইলা মিত্রের সংগ্রাম থেকে পাঠ নেয়।

১৯৪৫ থেকে ১৯৫৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ছিলেন—মাঠে-প্রান্তরে-সংগ্রামে এবং জেলে বন্দী অবস্থায়। নাচোলের তেভাগা আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা সে সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে হলেও ব্যক্তি ইলা মিত্রের সংগ্রামী চেতনার বিদ্রোহ অগ্নস্ফুিলিঙ্গের মতো উদ্দীপ্ত করেছিল সেই আন্দোলনের অধিকারহারা সাঁওতাল কৃষক নারী-পুরুষের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে।
১৯৪৮-এ শুরু হয়ে ১৯৫০ সালের প্রথম কাল পর্যন্ত নাচোলে তেভাগা আন্দোলন বা কৃষক বিদ্রোহ উত্তুঙ্গে উঠেছিল। সাঁওতাল এই কৃষকদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ভারত উপমহাদেশের সাঁওতাল পরগনা জেলার অধিবাসী। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সাঁওতাল আদিবাসীরা মহাবিদ্রোহের হুংকার তুলেছিলেন। সেই বিদ্রোহীরা এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের সাঁওতাল অধিবাসীরা নিজ বাসভূমে শান্তিতে বাস করতে পারেননি—হয়েছিলেন শোষিত, নির্যাতিত, জীবিকাবঞ্চিত দরিদ্র, নিঃশেষিত। এঁরা ছিলেন বর্গাচাষি। বর্গাচাষিদের শ্রমের ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ কেড়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে জোতদারেরা কৃষকের ন্যায্য অধিকারের ওপর আঘাত করলেন। কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক সাঁওতালদের সংগঠিত করে নাচোলের তেভাগা আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের পর সে সময় দেশের অন্যান্য স্থানের তেভাগা আন্দোলনের নতুন জাগরণ ঘটেনি—শেষ হয়ে গিয়েছিল তেভাগা আন্দোলনের কর্মকাণ্ড। হঠাৎ করেই নতুন পর্যায়ের তেভাগা আন্দোলন শুরু হলো নাচোলে।
নাচোল থানার চণ্ডীপুর গ্রামের সাঁওতাল নেতা মাতলা সরদার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। সেই এলাকার কমিউনিস্ট রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, অনিমেষ লাহিড়ী, শিবু কোড়ামুদি, বৃন্দাবন সাহা, আজহার হোসেন, চিত্ত চক্রবর্তী আত্মগোপনে থেকে সাঁওতালদের সংগঠিত করেছেন, এলাকার অন্যান্য হিন্দু-মুসলিম ধর্মনির্বিশেষে সব কৃষক সংগঠিত হয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে।
পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ-কর্তৃত্ব নাচোলের সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে কৃষক সমিতির নেতারা আহ্বান জানালেন আমন ধান কেটে তিন ভাগের দুই ভাগ ধান নিজেদের গোলায় তোলার জন্য। সে সময়ে পার্টির নেতা রণদীভের তত্ত্ব এবং নির্দেশিত সিদ্ধান্তে হঠকারীভাবে, অপ্রস্তুত পদ্ধতিতে নাচোলে কৃষক বিপ্লব ও পুলিশ-কৃষক সংঘর্ষ ঘটল এই ধান কাটা ও তিন ভাগের দুই ভাগ কৃষকের গোলায় তুলে নেওয়ার আন্দোলনের ফলে।
এ অবস্থায় পুলিশি আক্রমণের সময় ইলা মিত্র ছদ্মবেশে আত্মগোপনে যাওয়ার পথে ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি পুলিশের হাতে বন্দী হন রহনপুর স্টেশনে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত জেল-জুলুম আর শারীরিক-মানসিকভাবে পুলিশি সন্ত্রাস ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
১৯৫০-৫৪ পর্যন্ত তাঁর মুক্তির দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠায় পাকিস্তান সরকার।

 
ইলা মিত্রের সংগ্রাম সে সময় থেমে যায়নি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তিনি আজীবন রাজনৈতিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে নিবেদিত ছিলেন। একসময়ের ক্রীড়াবিদ ইলা সেন, বেথুন কলেজের ছাত্রী ইলা সেন। বিদ্রোহে-বিপ্লবে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠেছিলেন ইলা মিত্র। তাঁর জীবন ছিল কর্মময়। অধ্যাপনার পেশায় তিনি যেমন ছিলেন কর্মনিষ্ঠ, তেমনি নিবেদিত ছিলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। মানুষের কল্যাণ সাধনায় ছিলেন তিনি সক্রিয় মানবতাবাদী।
তাঁর সংগ্রামী জীবনের নানা দিকের আলোকপাতে আমরা জানি তিনি কখনোই অতিমানব হয়ে ওঠার আগ্রহ পোষণ করেননি; বরং সেই ধরনের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর সংগ্রাম ছিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ‘রাষ্ট্র বনাম অধিকারহারা মানুষের সংগ্রাম’। এই সংগ্রামের উত্তরাধিকারীদের কাছে তিনি দিয়ে গেছেন তাঁর এবং আরও সব বিপ্লবী-সংগ্রামীর অসমাপ্ত কাজ। সেই সংগ্রামের সূত্র ধরেই ইলা মিত্র আজও প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক এবং যুদ্ধ-সন্ত্রাসের শিকার করা হয়েছিল ইলা মিত্রকে। ‘নারীর বিদ্রোহ’ বলে ভাবা হয়েছিল তাঁর সংগ্রামকে। তাই তাঁর শরীরের ওপর নির্যাতনের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বীভৎস কদর্যরূপে নিজেদের কলঙ্ক লেপন করতে চেয়েছিল। পারেনি ইলা মিত্রের মনোবল ভেঙে দিতে। তাঁর পাশে এ দেশের অগণিত মানুষ দাঁড়িয়েছিল। নিপীড়িত মানুষ নিজেদের শিকল ছিঁড়েছে তাঁর বন্দিত্বের শিকল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে।
ইলা মিত্র জন্ম নিয়েছিলেন ১৮ অক্টোবর ১৯২৫ সালে। তাঁর জীবনাবসান হয়েছে ১৩ অক্টোবর ২০০২ সালে। ৭৭ বছরের সংগ্রামী, প্রাণস্ফূর্ত ইলা মিত্র দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। তাঁর স্মরণে ইতিহাসের মর্মবাণী গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে নিপীড়িত সাঁওতালসহ প্রান্তিক, দলিত, অধিকারহারা আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রূপান্তরিত হয়েছে সাঁওতাল-প্রান্তিক আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ পরিচয় বাংলাদেশের সংবিধানে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে। এমনকি সম্প্রতি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও তাদের আদিবাসী পরিচয়ের স্বীকৃতি মেলেনি।
ইলা মিত্রের সংগ্রামের যুগে যা ছিল ‘শ্রমের ফসল কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে’ বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, আজ তা হয়েছে ‘জাতিসত্তার পরিচয় কেড়ে নেওয়ার’ বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার অন্তহীন সংগ্রাম। এই সংগ্রামের সঙ্গে ঐতিহাসিক পরম্পরায় ইলা মিত্র সম্পৃক্ত হয়ে আছেন; থাকবেন যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত-অধিকারহারা মানুষের সংগ্রামের প্রেরণারূপে। প্রথম আলো

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons