Total Pageviews

Friday, September 2, 2011

মাহামুদা এখন সবার প্রিয়

হাতপাখা তৈরি করতে ব্যস্ত তারাগঞ্জ উপজেলার পাশারী পাড়া গ্রামের মাহমুদাসহ গ্রামের অন্য নারীরা হাতপাখা তৈরি করতে ব্যস্ত তারাগঞ্জ উপজেলার পাশারী পাড়া গ্রামের মাহমুদাসহ গ্রামের অন্য নারীরা
ছবি: প্রথম আলো
চতুর্থ শ্রেণীতে উঠে অভাবের কারণে স্কুল ছেড়েছিল মেয়েটি। ১৪ বছর বয়সে বাধ্য হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে বসতে। দিনমজুর স্বামীর সংসারে এসেও অভাব পিছু ছাড়েনি। জোটেনি ঠিকমতো দুইবেলা ভাতও। এরই মধ্যে মেয়েটি স্বপ্ন দেখেছে নিজে কিছু করার। একসময় শুরু করে হাতপাখা তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা। আসে সাফল্য। অভাবের সংসারে আসে সচ্ছলতা।
এই সংগ্রামী মানুষটির নাম মাহামুদা বেগম। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের পাশারীপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি।
হাতপাখা তৈরি করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাঁর দেখানো পথেই ওই গ্রামের অন্তত তিন শতাধিক গৃহবধূ দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। তালপাখা তৈরি করে বেশ কাটছে তাঁদের দিন।
মাহামুদা এখন গ্রামের সবার প্রিয়। তাঁর স্বামীর কথা, ‘অর জন্যে হামারা এলা সমাজোত মাথা উঁচা করি চলবার পারি।’
সংগ্রাম: তারাগঞ্জের হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের নদীরপার গ্রামে ১৯৬৫ সালে দরিদ্র পরিবারে জন্ম মাহামুদার। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবার অভাবের সংসার। ১৯৭৯ সালে বাবা মোবারক হোসেন কিশোরী মেয়েকে তুলে দেন পাশারীপাড়া গ্রামের খোয়াজ উদ্দিনের হাতে।
স্বামীর বাড়িতে এসেও সুখ হয়নি মাহামুদার। প্রায়ই অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হতো। কিন্তু এত অভাব, এত দরিদ্র তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাঁর কিশোরী মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। মুড়ি বানিয়ে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। এতে কিছু আয় হয়। এক বছরের লাভের টাকায় কেনেন চারটি ছাগল। তাঁর নতুন জীবনের গল্পটা এখান থেকে শুরু।
গল্পটা এ রকম: ১৯৯০ সালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা গ্রামের হাতপাখা বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম পাশারীপাড়া গ্রামে পাখা নিয়ে আসেন। মাহামুদা তাঁর কাছ থেকে দুটি পাখা কেনেন। হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি এলে তিনি মাহামুদার বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নেন। সারা দিনে ঝড়-বৃষ্টি না থামায় তাঁকে রাত যাপন করতে দেন মাহামুদার শ্বশুর আফজাল হোসেন। রাতে খাওয়ার সময় নানা কথার ফাঁকে রফিকুল মাহামুদাকে পাখা তৈরির পরামর্শ দেন। পরের দিন পাখা বিক্রি শেষে বিকেলে রফিকুল তাঁর বাড়িতে মাহামুদা ও তাঁর শ্বশুরকে নিয়ে যান। রফিকুলের স্ত্রী মমতাজ খাতুন মাহামুদাকে দুই দিনে শিখিয়ে দেন পাখা তৈরির কলাকৌশল।
বাড়ি ফিরে মাহামুদা তাঁর স্বামীকে তালপাতা সংগ্রহ করতে বললে তিনি এনে দেন। দুই দিনে মাহামুদা তৈরি করেন ২৫টি পাখা। এ পাখা বেঁচে আয় হয় ৮০ টাকা। খুলে যায় মাহামুদার চোখ। স্বামী-স্ত্রী লেগে পড়েন পাখা তৈরির কাজে। ভালো মুনাফা হওয়ায় বদলাতে থাকে সংসারের মলিন চেহারা।
তাঁর উন্নতি দেখে প্রতিবেশী অন্য নারীরা পাখা তৈরির কৌশল শিখতে আসেন। মাহামুদা তাঁদের শিখিয়ে দেন।
পাশারীপাড়া গ্রামের তিন শতাধিক গৃহবধূ ছাড়াও দামোদরপুর, ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের শতাধিক নারী এখন পাখা তৈরি করে বেশ আয় করছেন।
মাহামুদা পাখা বিক্রির টাকায় এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কিনেছেন আবাদি জমি। খড়ের ঘরের জায়গায় উঠেছে টিনের ঘর। বাড়িতে বসিয়েছেন নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। তিনটি গাভি, হাঁস-মুরগি ও ছাগল আছে। নলকূপের কিনারেই বানিয়েছেন ছোট্ট একটি পুকুর, তাতে চলছে হাঁস পালন ও মাছের চাষ। তাঁর দুই মেয়ে লেখাপড়া করছে। দুই ছেলে বিয়ের পর পাখার ব্যবসা করে আলাদাভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
মাহামুদার পথ ধরে: মাহামুদার পথ অনুসরণ করে যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের একজন লাইলী খাতুন। ১২ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। এখন প্রতি মাসে তাঁর গড়ে তিন হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
হাছিনা খাতুনের স্বামী মনোয়ার হোসেন জুয়া খেলতেন। হাছিনা সংসার চালাতেন ঝিয়ের কাজ করে। মাহামুদার পরামর্শে ১০ বছর আগে তিনি হাতপাখা তৈরি শুরু করেন। স্বামী জুয়া ছেড়ে এখন করেন পাখা বিক্রির ব্যবসা।
সোহাগী খাতুনের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। ভূমিহীন স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। তিন সন্তান নিয়ে প্রায়ই উপোস থাকতে হতো। এখন তাঁর পাখা তৈরির আয়ের টাকায় সংসার চলছে, স্বামীর আয় জমা থাকছে।
ওই পল্লিতে এক দিন: পাশারীপাড়া গ্রামের ৩০০টি পরিবারের কেউ পাখার কারিগর, কেউ ব্যবসায়ী। সম্প্রতি গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, কেউ পাখা বানাচ্ছে, কেউ তালপাতা পানিতে ভেজাচ্ছে। কেউ পাখার জন্য বাঁশের শলা কেটে রোদে শুকাতে দিচ্ছে। ঘরের কাজ সামলাতে সামলাতে, বিশ্রাম নিতে নিতে চলছে পাখা তৈরির কাজ।
মাহামুদার বাড়িতে দেখা গেল, তিনি পাখা বানাচ্ছেন। তাঁকে সহায়তা করছে দুই মেয়ে। গ্রামের অন্য ১৫-২০ জন নারীও তাঁর উঠানে বসে পাখা বানাচ্ছেন।
পাখার কারবার শুরু হয় চৈত্র মাস আসার আগেই। চলে কার্তিকের শুরু পর্যন্ত।
তৈরির কৌশল: ঘুরানি, পকেট, হরতন, মোড়া, একডান্ডা, ধাড়াইসহ বিভিন্ন ধরনের পাখা তৈরি করেন তাঁরা। পাখা তৈরিতে মূলত ব্যবহূত হয় তালপাতা, বাঁশ, খুদে পেরেক, সুই-সুতা ও রং। প্রথমে শুকানো তালপাতা চার-পাঁচ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তালপাতা পানি থেকে তুলে বাঁশের কঞ্চির কলম লাগিয়ে রোদে শুকাতে হয়। এরপর রাতে খোলা আকাশের নিচে রেখে সকালে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে তালপাতার চারদিকে গোলাকার করা হয়। সবশেষে পাখায় সুই-সুতার কাজ করা হয়। এরপর রং দিয়ে চোখ জুড়ানো নানা নকশা করা হয়।
পাখা তৈরির কারিগর আসমা খাতুন জানান, একটি তালপাতা তাঁরা নয়-১০ টাকায় গাছের মালিকদের কাছ থেকে কেনেন। একটি তালপাতা দিয়ে ১০ থেকে ১৪টি পর্যন্ত পাখা বানানো যায়। পাইকারেরা গ্রামে এসে পাখা কিনে নিয়ে যায়। এ পাখা চলে যায় দিনাজপুর, রাজশাহী, নীলফামারী, গাইবান্ধা। ঢাকায়ও যায়। প্রতিটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ে দুই থেকে তিন টাকা। বিক্রি হয় আট থেকে ১০ টাকা। একজন কারিগর দিনে ৩০-৩৫টি পাখা তৈরি করতে পারেন।
পরিবারের কথা: মাহামুদাকে নিয়ে গর্বিত তাঁর স্বামী খোয়াজ উদ্দিন। আলাপকালে বললেন, ‘বাহে, আগোত সমাজোত হামার কোনো দাম আছিল না। সোবায় মোক ডাকতো কিষান খাটা কয়া। অভাবের জন্যে মাহামুদার সাথে মোর প্রত্যেক দিন ঝগড়াও নাগছিলো। আশ্বিন-কার্তিক মাসতো থাকপার নাগছিলো সেক আলু উসা (মিষ্টি আলু সেদ্ধ) খায়া। মাহামুদাই সংসারের চাকা ঘুরি দিছে। অর জন্যে হামরা এলা সমাজোত মাথা উঁচা করি চলবার পারি।’
মাহামুদার ছেলে রবিউল ইসলামেরও একই কথা, ‘আগতো গ্রামের ছেলেমেয়েরা হামাক কিষান খাটার বেটা কয়া গালি দিত। এলা ওমরা ফির ডাকি কথা কয়, আদরও করে।’
তাঁরা যা বলেন: সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা সদস্য রেহেনা আক্তার বলেন, আগে ওই গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। তারা সরকারি ত্রাণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে ধরনা দিত। গ্রামের নারীরাও তাঁদের স্বামীর হাতে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতেন। এখন গ্রামটির চিত্র বদলে গেছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুন নবী বলেন, ‘পাশারীপাড়া গ্রামের নারীরা পরিশ্রমী। তাঁরা সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরি করে যেভাবে বাড়তি আয় করছেন, অন্য এলাকার নারীরাও তাঁদের অনুসরণ করে অনুপ্রেরণা পেতে পারেন।’
রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর Prothom-alo

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons