পঞ্চগড় পৌরসভার তুলারডাঙ্গা গ্রামে জনির পাঠশালায় পাঠদান চলছেছবি: প্রথম আলো
মর্মান্তিক এ ঘটনা প্রতিবেশী এক তরুণের মনে নাড়া দেয়। ওই তরুণ ভাবেন, ওই মা যদি লিখতে-পড়তে পারতেন, তবে হয়তো এমন ভুল করতেন না। এসব মানুষকে শিক্ষার আলো দেওয়ার ব্রত নেন তিনি। সেই ব্রত থেকেই গ্রামে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। গৃহশিক্ষকতা করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে যাত্রা শুরু সেই পাঠশালার, যেটি পরিচিতি পায় ‘জনির স্কুল’ নামে।
তরুণের নাম নজরুল ইসলাম জনি। পঞ্চগড় পৌরসভার তুলারডাঙ্গা গ্রামে তাঁর বাড়ি। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। এরপর ওই স্কুল নিয়েই ব্যস্ত।
শুরুর কথা: মন নাড়া দেওয়া ওই ঘটনাটি ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের। এ ছাড়া লেখাপড়া না জানায় গ্রামের সাধারণ মানুষের নানাভাবে প্রতারণার শিকার হওয়া, শিশু ও নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, মাদকের ছোবল তো আছেই। বিষয়টি ভাবায় জনিকে। তিনি চিন্তা করেন, শিক্ষাই এর সমাধান। এসব নিয়ে আলোচনা করেন সহপাঠী একই গ্রামের একরামুল হাসানের সঙ্গে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন পাঠশালা গড়বেন। দুই বন্ধু মিলে ঠিক করেন জনির বাড়ির পাশের সুপারির বাগানে গ্রামের নিরক্ষরদের পড়ানো হবে।
জনি ও একরামুল তাঁদের ইচ্ছার কথা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানান। নিরক্ষর নারী-পুরুষকে পড়তে আসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু নারীদের ঘর থেকে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁরা হাল ছাড়েননি। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে খোলা আকাশের নিচে শুরু হয় লেখাপড়া। প্রথমদিকে সেখানে পড়তে আসত মাত্র ১৮ থেকে ২০ জন। দুটি পালায় পড়ানো শুরু হয়। বিকেলে পড়েন নারীরা, রাতে পুুরুষেরা। জনির প্রাইভেট পড়ানোর টাকায় কেনা তিনটি হারিকেন ও পাঁচ লিটার কেরোসিন তেল দিয়ে শুরু হয় রাতের পড়া।
দিনের পালায় পড়ানো ভালোমতো চললেও রাতের পালায় সমস্যা হতো। কারণ, কেরোসিন কেনার খরচ কম নয়। একপর্যায়ে একরামুলের সহায়তা আর পান না জনি।
জনির হার না মানা মানসিকতা দেখে এগিয়ে আসেন গ্রামের দিনার চৌধুরী। দুজনে মিলে স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের বই, খাতা-কলম, চক-ডাস্টার, বসার চট, মোমবাতি-হারিকেনসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করেন। তার পরও যেন এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছিল না। জনির উদ্যোগের কথা জানতে পেরে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা এগিয়ে আসেন।
জনির বাড়ির উঠানে টিনের চালা করে বানানো হয় পাঠশালা। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বর্তমানে তিন পালায় চলছে পাঠদান। দুপুরের পালায় পড়ানো হয় শিশুদের। বর্তমানে এ পালায় সুবিধাবঞ্চিত ৩৬টি শিশু পড়াশোনা করছে। বিকেলের পালায় পড়ছেন ৩০ জন নারী। আর রাতের পালায় পড়েন ২৫ থেকে ৩০ জন পুরুষ। কাউকে বেতন দিতে হয় না।
পাঠশালার শিক্ষক বলতে জনি নিজেই। শিশুরা ছয় মাস এখানে পড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়। বয়সী নারী-পুরুষেরাও ছয় মাস এখানে পড়েন।
আরও কিছু: জনির পাঠশালায় লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রথা রোধ, ঝগড়া-বিবাদ নিষ্পত্তি, মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। বিপদে-আপদে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করা, সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলা, বাড়িতে ছোটখাটো খামার তৈরি, শাকসবজির বাগান, হাঁস-মুরগি-কবুতর, গরু-ছাগল পালনেও উদ্বুদ্ধ করা হয়।
একদিন পাঠশালায়: জনির পাঠশালায় ঢুকে দেখা গেল, দুই সারিতে বসে শিশুশিক্ষার্থীরা বই নিয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার জানাল, সে আগে স্কুলে যেতে পারেনি। এখন জনির স্কুলে এসে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক সব বিষয় পড়ছে।
কথা হলো বিকেলের পালায় পড়তে আসা গৃহবধূ আছিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বললেন, পড়তে না পারায় ওষুধ ভেবে ছেলেকে কীটনাশক খাইয়েছিলেন। সেই যন্ত্রণা এখনো ভোগ করছেন। এ স্কুলে এসে এখন পড়া ও লেখা দুটোই পারেন। ‘ছোটবেলায় পড়ালেখা করতে পারিনি। কম বয়সেই বিয়ে হয়। পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল। এখন এই স্কুলে এসে পড়াশোনা করছি।’ বলছিলেন গৃহবধূ মমতাজ বেগম। গৃহবধূ সহিদা বেগম বললেন, প্রথম প্রথম পড়তে আসতে লজ্জা লাগত। কিন্তু এখন ভালোই লাগছে।
সারা দিন খাটা-খাটুনির পর রাতের পালায় পড়তে আসেন মনজুর রহমান (৪০)। ‘পড়াশোনা না জানলে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এখন পড়তে ও লিখতে পারি।’ সরল উত্তর মনজুরের।
অন্যদের কথা: জনির সহযোগী দিনার বলেন, ‘জনির মহ ৎ উদ্যোগ আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই ওঁর সঙ্গে যোগ দিই। এই উদ্যোগে সহযোগিতা করতে পেরে ভালোই লাগছে।’
জনির বাবা আবদুস ছাত্তার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আবদুস ছাত্তার বলেন, এ কাজকে প্রথমদিকে ছেলের পাগলামি মনে হতো। এখন সবাই ছেলের প্রশংসা করে। খুব গর্ব হয়।
পঞ্চগড়-১ আসনের সাংসদ মো. মজাহারুল হক প্রধান এ উদ্যোগের প্রশংসা করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এমন উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। একই কথা বলেন পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র তৌহিদুল ইসলাম। তিনি স্কুলের উন্নয়নে সহযোগিতাও করেছেন।
জনির ইচ্ছা: এরই মধ্যে কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন জনি। সাক্ষরতাদানে বিশেষ অবদান রাখায় ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে জেলা প্রশাসন জনিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সম্মাননা সনদ’ দিয়েছে।
জনি বলেন, ‘ইচ্ছা আছে পাঠশালার জন্য একটি পাকা ঘর তৈরি করার। সেখানে বিদ্যু ৎ, পানীয় জল এবং শৌচাগার থাকবে। এ ছাড়া সুযোগ পেলে এ এলাকার প্রতিটি গ্রামে এমন একটি করে পাঠশালা গড়ে তুলব।




10:51 PM
Akashnill
Posted in:
0 comments:
Post a Comment