Total Pageviews

Saturday, June 11, 2011

আমার মাথায় চাটি মেরে দৈত্যটা উড়ে গেল….ইনাম আল হক


‘দৈত্য, দৈত্য—পেট্রেল আসছে, মাথায় ঘা মারবে, বসে পড়ো বোকারাম, বসে পড়ো।’ চিৎকার করে এসব নির্দেশ দিতে দিতে ব্রেন্ট হিউস্টন হঠাৎ বসে পড়ে উত্তর দিকে সেজদা দিল। নির্দেশগুলো আমার উদ্দেশেই ছিল, কিন্তু আমার মাথায় তখন কি আর কিছু ঢোকে! দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শেষে সদ্য অ্যান্টার্কটিকায় পা ফেলেছি, তারপর ‘প্যারাডাইস বে’ বা স্বর্গোপকূলের পাথুরে দেয়ালে আরোহণ করে একেবারে ঘোরের মধ্যে আছি। সমুদ্রের গর্জন কমে এসেছে, সৈকতে আমাদের সহযাত্রীদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শত শত ‘অ্যাডেলি পেঙ্গুইন’। আজ শীতের তীব্রতা কমেছে, তাপমাত্রা বেড়ে শূন্য ডিগ্রিতে এসেছে, সারাক্ষণ ঝুরঝুর করে তুষার ঝরছে। পাহাড়ের ওপর ওড়াউড়ি করছে দক্ষিণ মহাসাগরের বিরল পাখি, দৈত্য-পেট্রেল ও খয়রা-স্কুয়া। কাছে গিয়ে এদের দেখার জন্য আমরা দুই পাখিপ্রেমী পাহাড়ে উঠেছি। আরোহণের শ্রমে শরীর গরম, মন আরও উষ্ণ। গায়ের প্রকাণ্ড লাল জ্যাকেট খুলে ফুরফুরে মনে আমি ব্রেন্টকে বললাম, ‘এ স্বর্গোপকূলে আমার একটা ছবি তুলে দাও।’
ব্রেন্ট হিউস্টন আমেরিকার পাখিবিশেষজ্ঞ। পেঙ্গুইন-গবেষক হিসেবে তার অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণের পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে; অভিযাত্রী ও পাখিবিদ হিসেবে আমার মতো ভুঁইফোড় নয় সে। পাহাড়ে চড়ে ‘সাদার্ন জায়ান্ট পেট্রেল’ আর ‘ব্রাউন-স্কুয়া’র বাসা দেখার প্রস্তাবটা তার। তবে এ পাহাড়ে চড়ায় যে বিপদ আছে, সে কথা জানাতে ভোলেনি ব্রেন্ট। যেখানেই যাও না কেন, পাখির বাসা থেকে সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ভীমের মতো প্রকাণ্ড আর রাগী এ পাখিদের পাথুরে নীড়ের ৫০ মিটারের মধ্যে গেলে তারা আক্রমণ করে; আকাশ থেকে গোলার মতো ছুটে এসে অনধিকার প্রবেশকারীর মাথায় ঘা মারে। ব্রেন্ট নিজেই একজন ভুক্তভোগী, আগের এক সফরে স্কুয়া পাখির ঘা খেয়ে সে সাময়িক জ্ঞান হারিয়েছিল। তবে আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না, মগজে রক্তক্ষরণ হয়নি, পাখিবিদ হিসেবে খ্যাতিটুকুও মোটামুটি অক্ষত ছিল।
আক্রমণের শিকার হওয়ার পর থেকে ব্রেন্ট বিপজ্জনক এলাকায় মুঠিবাঁধা একটা হাত মাথার ওপর তুলে হাঁটে। তার ধারণা, এভাবে চললে পাখি হাতেই আঘাত করবে, মাথা রক্ষা পাবে। আমরা মাথার ওপর হাত রেখেই পাহাড়ে উঠেছি। পাথরের প্রান্তরে বড় বড় নুড়ি জড়ো করে পেট্রেল আর স্কুয়া পাখি বাসা বানায়। কার সাধ্যি বিনা দুরবিনে সে বাসা ঠাহর করে! একবার এ-হাত একবার ও-হাত তুলে চলতে চলতে আমি হয়রান। তাই একসময় হাত নামিয়ে ব্রেন্টকে আমার ছবি তোলার কথা বলে জ্যাকেট খুলে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ছবি তুলতে তুলতে ব্রেন্ট হঠাৎ দেখেছে, আকাশে ধূসর রঙের এক উল্কাপিণ্ড আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। চেঁচিয়ে আমাকে সাবধান করেই ব্রেন্ট সেজদা দিয়েছে। আর আমি কিছু না-বুঝেই তাকে অনুকরণ করেছি, তবে অনেক ধীরগতিতে। ব্রেন্ট যখন সেজদা করছে, আমি তখন কেবল রুকু দিচ্ছি। ফলে যা হওয়ার হলো, সাত ফুট বিস্তৃত ডানার এক দৈত্য-পেট্রেল আমার মাথা লক্ষ্য করে এগিয়ে এল। তবে লক্ষ্য ভেদ হলো না, ডানা দিয়ে আমার মাথায় সপাং করে চাটি মেরে দৈত্যটা উড়ে গেল।
ব্রেন্ট বলল, ‘প্রথম আক্রমণ থেকে বেঁচেছি, চলো, হামাগুড়ি দিয়ে সরে পড়ি, কাছেই কোথাও পেট্রেলের বাসা আছে।’ পাহাড়ের ঢালে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে আমি বললাম, ‘ব্রেন্ট, এত কাছে দৈত্য-পেট্রেল দেখতে পাব আশা করিনি।’ ব্রেন্ট বলল, ‘ঈশ্বর যেন আর না দেখান।… শোনো, আমি দুঃখিত, তোমাকে বসানোর জন্য অভদ্রভাবে ধমক মেরে কথা বলেছিলাম। তুমি মাইন্ড করোনি তো?’ আমি ভদ্রতা দেখিয়ে বললাম, ‘না, তুমি যে বলেছিলে “সিট ডাউন, ইউ ফুল”, সেটা আর কারও কানে গেলে আমি মাইন্ড করতাম।’ ব্রেন্ট হেসে বলল, ‘কানে গেছে, কিন্তু ওরা বোঝে নাই, স্কুয়া আর পেট্রেল কি আর ইংরেজি জানে?’

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons