Total Pageviews

Sunday, June 12, 2011

তিন তরুণের স্বপ্ন-উদ্যোগ


undefined
তাঁদের মাথায় ঘুরতে থাকে ‘আইডিয়া’। একটি ভাবনা নিয়ে তিনজন মগ্ন থাকে দিনের পর দিন। সেই ভাবনাই এনে দেয় পুরস্কার। বদলে দেয় তাঁদের জীবন। বলছি সাবাবা ইসলাম, সিফাত সারোয়ার ও সাজ্জাদুর রহমানের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী তাঁরা তিনজন।
‘এখন আমরা তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। এর আগে দুই বছর তরুণ উদ্যোক্তা পুরস্কারে শুধু বড়দের অংশগ্রহণ দেখতে গিয়েছি। এবার ভাবলাম নিজেরাই করি। দেখি পারি কি না। নানা আইডিয়া মাথায় ঘুরতে লাগল। একই ক্লাসের হওয়ায় আমরা একে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করতাম। তবে এ প্রকল্পের চিন্তাটা প্রথম আসে সাজ্জাদের মাথায়। কৃষিভিত্তিক এমন কিছু, যা পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু কীভাবে করব বুঝতে পারছিলাম না। এরপর এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করি। ইন্টারনেটে নানা তথ্য পাই। এগিয়ে যেতে থাকে কাজ।’ শুরুর কথা এভাবেই বলেন সাবাবা।
‘এইচএসবিসি তরুণ উদ্যোক্তা পুরস্কার ২০০৯-১০’ বাংলাদেশ পর্ব জয় করার পথে তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথাও শোনা গেল। চূড়ান্ত পর্বে যখন জানা গেল, ওঁরাই সেরা, তখন অদ্ভূত এক আনন্দে ভরে গেল ওদের মন। গত পাঁচ মাস এই তিনজন ছিলেন যেন ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোর এখনো কাটেনি। তাঁরা তাঁদের স্বপ্নকে নিয়ে গেছেন এক ধাপ এগিয়ে। এই তরুণেরা প্রমাণ করতে পেরেছেন নিজেদের। পরিচিত করেছেন উদ্যোক্তা হিসেবে।
এখন তাঁরা কেমন আছেন, তা জানা যাক। সকালে পরীক্ষা। মাঝে খানিকটা বিরতি। দুপুরে ফের পরীক্ষা। এরই ফাঁকে কথা হয় ওদের সঙ্গে। ‘কাজের জন্য পড়ার বেশ ব্যাঘাত হয়েছে। এখন তা পুষিয়ে দিতে হচ্ছে।’ জানালেন ওরা। এভাবেই নিজেদের কথা শুরু করেন। জানান গত পাঁচ মাসের ঘোরলাগা দিনের গল্প। সেই ঘোর এখনো কাটেনি তাঁদের। একটি পুরস্কার বদলে দিয়েছে জীবন।
‘কী কাজ করেছেন আপনারা। কোন কাজ এনে দিল এত বড় একটি পুরস্কার?
একটু হেসে সাজ্জাদ বলেন, ‘সার নিয়ে তো কত ঘটনা ঘটে। কৃষকের ভোগান্তি পোহাতে হয়। এত কষ্ট করে যে সারটা জমিতে দেন, তাও পুরোপুরি থাকে না। বৃষ্টি, বন্যা ও প্রাকৃতিকভাবে সারের উপাদানের ৬০ ভাগ চলে যায়। কী করা যায় ভাবতে লাগলাম। শেষে উপায় বের হলো। তখন গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরির চেষ্টা করি। কারওয়ান বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনলাম। তৈরি করি ‘বায়োচার প্রক্রিয়াটি’। এর মাধ্যমে জ্বালানির কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হতে পারে না, যা জলবায়ুতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারবে না। 
তৈরি হয় ভূমিবান্ধব জৈব সার। জমিতে এটি ছিটিয়ে দিলে সার কখনোই ধুয়ে যাবে না। সারের গুণাগুণ বজায় থাকবে।’ উত্পাদন কৌশল বের হলো। কিন্তু একে তো বাণিজ্যিকীকরণ করতে হবে। তখন এর দায়িত্ব তুলে নেন সিফাত। এ জৈব সারের বিপণনের নানা দিক তুলে ধরেন।
পছন্দ হয় অপর দুজনের। কিন্তু আর্থিক দিকটাও বিবেচনা করতে হবে। কৃষকের আবার লোকসান হবে না তো। সেটিও তাঁরা হিসাব করে তৈরি করেন। দেখেন, এতে কৃষকের লাভই হবে। গত ৫ মে তাঁরা এ প্রকল্পটি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। জিতে নেন স্বর্ণপদক। দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মজার কিছু হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তাঁরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। এই দলের দলনেতা সাবাবা বলেন, ‘প্রতিদিনই কত কিছু ঘটত। মজাও ছিল। সাজ্জাদ তো রোবটের মতো কাজ করত। কিছু জিজ্ঞাসা করলে না তাকিয়েই উত্তর দিত।’ সিফাত বলে ওঠেন, ‘মাঝেমধ্যে মতামত মিলত না আমাদের। একেকজন একেকটা বলতাম। এতে নিজেদের ভাবনার ভুলগুলো উঠে আসত, যা পরে কাজে লেগেছে।’
এই প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর। তরুণদের এ উদ্যোগী মনোভাব ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে তিনি অভিভূত। পড়াশোনা শেষ করেই চাকরিতে ঢোকার পক্ষপাতী তিনি নন। তিনি বলেন, ‘তরুণদের এ উদ্যোগী মনোভাবকে ধরে রাখতে হবে। চাকরি না করেও নতুন কিছু তৈরি করেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। যোগ্যতাকে প্রমাণ করা যায়, যা দেশের জন্য খুবই প্রয়োজন।’
কিন্তু এই তিন তরুণ কী ভাবছেন? ‘আমরা এখনো ছাত্র। লেখাপড়া শেষ করে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য চাকরিতে ঢুকব। কেননা, উদ্যোক্তা হতে হলে কাজের পরিবেশ, অভিজ্ঞতা সবই থাকতে হবে। এরপর অবশ্যই এই প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করব।’ এমন ইচ্ছা তাঁদের তিনজনেরই। এর বাইরেও নারীর ক্ষমতায়ন, আইটি শাখার উন্নয়ন ও সবাই মিলে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন তাঁরা। এই সাফল্যের পেছনে পরিবার, বন্ধু, বড় আপু-ভাইয়াদের ভূমিকা ছিল অনেকখানি।
‘আমাদের ক্লাস থেকে আরও অনেকে অংশ নিয়েছিল। তারা বাদ পড়ে গেছে। তবুও আমাদের সাহায্য করেছে। অনুপ্রেরণা দিয়ে যেত। আসলে আশা পূরণ করতে পেরেই বেশি ভালো লাগছে।’ বলেন সাবাবা। এ মুহূর্তে ওদের একটাই স্বপ্ন—মালয়েশিয়ায় গিয়ে দেশের জন্য পুরস্কার জিতে আনা। কাঁধে এখন দেশের দায়িত্ব। দি হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি) বাংলাদেশের বিপণন ও যোগাযোগ বিভাগের প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান খান জানান, এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের আরও দুটি দল রৌপ্য ও তাম্র পদক অর্জন করে। ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এ বছর ৩৬৫টি দল প্রাথমিকভাবে তাদের আইডিয়া জমা দেয়। সেখান থেকে ৩০টি দল বেছে নেওয়া হয়। নিয়মানুসারে দু-তিনজন সদস্য মিলে একেকটি দল হতে হবে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। যেকোনো বিভাগের হতে পারে। তাদের ব্যবসায়িক নানা বিষয়ের ওপর কর্মশালা করানো হয়। এরপর সেখান থেকে সাতটি দলকে বেছে নেওয়া হয়। তারাই চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে। এবারের বিজয়ী দল মালয়েশিয়ায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশের স্বর্ণপদক বিজয়ীদের সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। সেখানে সেরা দলকে দেওয়া হবে বাংলাদেশি আট লাখ টাকার সমমূল্যের হংকং ডলার। এ ছাড়া অন্য দুটি দল শিক্ষাসফর করবে মালয়েশিয়ায়। এ ছাড়া পুরো প্রতিযোগিতা তারা পর্যবেক্ষণ করবে।
জুনের শেষের দিকে তিনটি দলই যাবে মালয়েশিয়ায়।
মোস্তাফিজুর রহমান খান আরও বলেন, ‘আমরা চাই তরুণেরা আরও এগিয়ে আসুক। প্রতিবছরই তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের ভিত্তিটা স্থাপন করে দিতে চাই। যাতে করে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারে। আমরা প্রতিটি দলকে পুরস্কার হিসেবে অর্থও দিয়ে থাকি। যাতে করে নিজের প্রকল্প ও পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে পারে। এ আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নানা দেশের নানা পরিবেশ ও চাহিদার কথা জানতে পারে। নিজের ফাঁকফোকর সহজেই বুঝতে পারে। আসল বিষয় হলো, অন্যকে জানা আর নিজেকে বোঝার সুযোগ করে দেওয়া, যা একজন উদ্যোক্তার জন্য খুবই দরকার।’

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Wordpress Theme | Bloggerized by Free Blogger Templates | JCPenney Coupons