ফেনীর একই পরিবারের তিন মেয়ে ফুটবলার। তাদের ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প শোনাচ্ছেন বদিউজ্জামান
আবদুল মালেক মজুমদারের ছোট মেয়ের নাম বাবু। বাবু আবার মেয়েদের নাম হয় নাকি? প্রশ্নটা করতেই বাবুর উত্তর, ‘সবার ছোট বলে আদর করে সবাই বাবু নামেই ডাকত আমাকে, সেই থেকে আমি বাবু।’ পুরো নাম সৌদিয়া আক্তার বাবু। ফুলগাজী পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী বাবু এবারের জাতীয় মহিলা ফুটবলের আঞ্চলিক পর্বে খেলল ফেনী জেলা দলের হয়ে। সে দলের মূল গোলরক্ষক। আবদুল মালেকের আরও দুই মেয়ে খেলে ফেনী দলে। রাবেয়া আক্তার কাকন স্ট্রাইকার, ফৌজিয়া আক্তার বিন্তু ডিফেন্ডার।
চূড়ান্ত পর্বে ওঠার জন্য বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে কিশোরগঞ্জের সঙ্গে প্লে-অফ ম্যাচ খেলে ফেনী। কিন্তু টাইব্রেকারে হেরে হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরতে হয়েছে তিন বোনকে।
আবদুল মালেকের পরিবারটাই ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ। তিন মেয়ের পাশাপাশি ছেলে নুরুল হক পেশাদার ফুটবল লিগের দল ফেনী সকার জুনিয়র দলের গোলরক্ষক। আরেক ছেলে আবদুল্লাহ মজুমদার খেলছে নোয়াখালী লিগে।
আর দশজন অভিভাবক যেখানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন নিয়ে লেখাপড়া শেখান ছেলেমেয়েদের, সেখানে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কর্মকর্তা আবদুল মালেক শুরু থেকে জোর দেন ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার ওপর। ‘নিজেও ফুটবলার ছিলাম। আশির দশকে খেলেছি ফেনী দলে। আমার মেয়ে বিন্তু সাত বছর ধরে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলে। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন। অ্যাথলেটিকসেও ভালো। কাকন দুই বছর ধরে জেলা পর্যায়ে খেলে। বড় ভাই আবদুল গোফরান মজুমদার স্বাধীনতার আগে ফুটবল খেলেছেন। যখন দেখি ওরা খেলাধুলায় ভালো করছে, তখন বাধা দিই না।’ বলেন গর্বিত মালেক।
ফুটবলে কত মেয়েই তো আসে, আবার হারিয়েও যায়। বাবু-কাকনরা টিকে থাকতে পারবে? অন্তত স্বপ্ন দেখতে বাধা নেই আবদুল মালেকের, ‘আগেভাগেই ওদের বিয়ে দিতে চাই না।’ শত ব্যস্ততার মধ্যেও মেয়েদের খেলা দেখতে তিনি স্টেডিয়ামে ছুটে যান স্ত্রীকে নিয়ে। কমলাপুরে ফেনীর প্রথম ম্যাচেও সস্ত্রীক দেখা গেছে তাঁকে।
ফুলগাজী পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী কাকন হতে চেয়েছিল ক্রিকেটার। কাকন জানায়, ‘প্রথমে আমার ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ছিল। ব্যাডমিন্টনও খেলতাম। আমাদের স্থানীয় কোচ দীপক স্যার (দীপক চন্দ্র) একদিন আমাকে ফুটবল খেলতে দেখেন। আমার খেলায় মুগ্ধ হয়ে ফুলগাজী মহিলা ফুটবল দল গড়ার সময় আমাকে ডাকেন। প্রথম প্রথম জার্সি পরে, ট্র্যাকসুট পরে প্র্যাকটিসে যেতে দেখলে পাড়ার ছেলেরা হাসাহাসি করত। ঠাট্টা করে বলত, এই মেয়ে খেলোয়াড় হবে! শুনে খুব কষ্ট লাগত। কিন্তু এখন আর কেউ কিছু বলে না।’
ঢাকায় নরসিংদীর বিপক্ষে কাকনের জোড়া গোলেই জিতেছিল ফেনী। দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে কাকনের, ‘এর আগে কখনো ফ্লাডলাইটে খেলিনি। সেদিন তাই খুব ভয় করছিল। একটু নার্ভাসও লাগছিল। এত বড় মাঠ, এর ওপর আবার ফ্লাডলাইটে খেলা।’
ফুলগাজী মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী বিন্তুও ‘অলরাউন্ডার’, ‘ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, সাঁতার—তিনটিতেই পারদর্শী আমি। তবে ফুটবলই বেশি ভালো লাগে। জাতীয় দলে নাম লেখানোর স্বপ্ন আমার।’ সবার ছোট বাবু ভালো গান গাইতে পারে। খেলার জন্য গান ছেড়ে দিয়েছে।
তিন বোনেরই প্রিয় ফুটবলার লিওনেল মেসি। বাংলাদেশে এলে ঢাকায় স্টেডিয়ামে এসে আর্জেন্টাইন তারকার খেলা দেখবে বলেও জানাল তারা।
ফেনীর কোচ তৌহিদুল ইসলাম এই মেয়েদের মধ্যে দেখছেন দারুণ সম্ভাবনা, ‘ওরা তিন বোনই খুব ভালো খেলে। সঠিক পরিচর্যা পেলে ওরা আরও ভালো ফুটবলার হয়ে উঠবে।’
সেই স্বপ্ন নিয়েই কাকন-বিন্তু-বাবুদের এগিয়ে চলা।